ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

তদারকির অভাবে পশ্চিম রেলে বেহাল দশা, ঘটছে দুর্ঘটনা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৯
তদারকির অভাবে পশ্চিম রেলে বেহাল দশা, ঘটছে দুর্ঘটনা

রাজশাহী: তদারকির অভাবে চরম বেহাল দশা পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। তড়িঘড়ি করে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু মেরামতের কাজ। সপ্তাহে দুদিন সরেজমিনে ঘুরে রেলওয়ে ট্র্যাকের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে প্রকৌশলীদের। 

তবে পরিদর্শনের সেই নিয়ম পালন হচ্ছে কাগজে-কলমেই। এর ওপর দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নড়বড়ে ‘রেলট্র্যাক’ (লাইন) ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ফলে হরহামেশায় ঘটছে লাইনচ্যুতির ঘটনা। আর একই কারণে গতি আসছে না ট্রেন চলাচলেও।

এ রুটে প্রায় লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও ট্র্যাক মেরামতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে কিছুদিন পরপরই ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে।  

সরেজমিন এ রেল রুটের হরিয়ান স্টেশনের কাছে গিয়ে দেখা যায়, লাইনের ভগ্নদশা। সেখানে সমান্তরাল তিনটি লাইনের মধ্যে তিন নম্বর লাইনটি চলাচলের অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে।

গত ১১ মার্চ রাতে রাজবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীমুখী ‘মধুমতি এক্সপ্রেস’ নামের একটি ট্রেন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে হরিয়ান স্টেশনের কাছে এসে হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়।
অথচ দুর্ঘটনার দিন সেই লাইন দিয়েই চালানো হয় ট্রেনটি। সেই ট্র্যাকে গিয়ে দেখা যায় পুরাতন কাঠের স্লিপারগুলোকে সারিবদ্ধ করে ধরে রাখতে ৫৪ নম্বর রেলব্রিজের ওপর স্লিপারগুলোতে প্রযুক্তিগত পদ্ধতির বাইরে বাঁশের বাতা ব্যবহার করা হয়েছে। আর ৬৮০ মিটার সংস্কারাধীন দুই নম্বর লাইনটির মেরামত কাজ শেষ না হতেই তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয়।

পবার হরিয়ান স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার লাইনের দুইধারেই বিরাট গর্ত রয়েছে। নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়ায় রেললাইনগুলো গড়ে উঠেছে। স্টেশনের তিনটি রেল লাইনের মধ্যে ২ নম্বর লাইনে মেরামতের কাজ করা হয়েছে।

তবে সংস্কার করা লাইনটিতে এখনো পাথর বসানো হয়নি। কংক্রিট স্লিপারের সঙ্গে লাইনের সংযোগ ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ক্লিপ বসানো হয়নি। এক ও তিন নম্বর লাইনের পাত ঘেঁষে বিভিন্নস্থানে ফেলে রাখা হয়েছে পাথর ও মাটির স্তূপ।  

দুর্ঘটনা কবলিত তেলবাহী ওয়াগন।  ছবি: বাংলানিউজতিননম্বর লাইনের পুরোটা জুড়ে গজিয়েছে ঘাস। অযত্ন ও অবহেলায় লাইনটির এখন বেহাল দশা। তার উপর দিয়েই চলছে আন্তঃনগরসহ মালবাহী ট্রেন।

এরপর গত ১০ জুলাই রাজশাহীর চারঘাটের দীঘলকান্দিতে তেলবাহী ট্রেনের আটটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় ২৮ ঘণ্টা রাজশাহীর সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে।

এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে আবদুর রশিদ নামে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একজন সহকারী প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আর এ ঘটনার ধকল সামলাতে আরও প্রায় এক সপ্তাহ সিডিউল বিপর্যয় চলে পশ্চিমাঞ্চল রেলে।

এদিকে, ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর পর্যন্ত থাকা সিঙ্গেল লাইন, সিগন্যাল ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলছে বলে মনে করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।  

তবে পূর্ব রেলের আওতাধীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের কর্মকর্তা। রাজশাহী-ঢাকা রুটসহ পশ্চিমাঞ্চলের  রুটগুলোতেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা।

বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে দেড় হাজার কিলোমিটার পথে ১ হাজার ৩৬৭টি সেতু রয়েছে। তবে এগুলো বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের তৈরি। এরপর থেকে সেতুগুলোর ব্যবহার চলছে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে।  

বছর বছরে কেবল মেরামত করা হয়েছে। ফলে সেতুগুলো এখন বেহাল অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্রায় প্রতিটি সেতুই হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ।

দুর্ঘটনা কবলিত একটি ট্রেন।  ছবি: বাংলানিউজপশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, সপ্তাহে অন্তত দুইদিন লাইন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। তবে এ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি রেলওয়ের সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।  

তাদের দাবি, লোকবল সংকটে ভুগছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। যে কারণে নিয়ম বা ইচ্ছা থাকলেও সব সময় তা মানা সম্ভব হয়ে উঠেছে না। তবে এর পরও তাদের তদারকি কাজ প্রায় ঠিকঠাকই চলছে।

এদিকে, পাবনার পাকশীতে পদ্মানদীর ওপর নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। ফলে বিষয়টি এখন ভাবিয়ে তুলেছে কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সিগন্যাল ব্যবস্থাকেও বর্তমানে হুমকির মুখে ফেলেছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. আসাদুল হক বলেন, প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে একজন সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে রেলওয়ে লাইন পরিদর্শন করা হচ্ছে। এরপরও বিভিন্ন কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই এখন বাড়তি সতর্ক অবলম্বন করা হয়েছে।  

আর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার জানান, পাবনার ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর স্টেশন পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইনটি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেকশন। এই সেকশনটা সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ।

তবে সেখেনে শিগগিরই ডাবল লাইন ও ডুয়েলগেজ হবে বলে জানান তিনি। এই কর্মকর্তার ভাষ্য, কাজটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই সেকশনটিতে ডুয়েল লাইন ডুয়েল গেজ হলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ট্রেন চলাচলে আশানুরূপ পরিবর্তন আসবে।  

ট্রেন লাইনের বেহাল দশা।  ছবি: বাংলানিউজএটি বাস্তবায়ন হলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের রুটগুলোতে বিরতিহীন ট্রেন চলাচলসহ অন্যান্য আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের জন্য তা মাইলফলক হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।

প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার বলেন, লাইনের কারণে সময় বেশি লাগলেও স্টেশন মাস্টার ও চালকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে গতিসীমা ঠিক করে দেওয়াসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।

তিনি বলেন, নির্দেশনা রয়েছে, কোনো ধরনের ত্রুটি ধরা পড়লে তার সঙ্গে সঙ্গেই চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সেখানে দ্রুত প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।  

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিরাজগঞ্জের ঘটনার পর আবারও নতুন করে সব স্টেশন মাস্টার এবং ব্লক মাস্টারকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই প্রকৌশলী।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৯
এসএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।