বুধবার (১১ ডিসেম্বর) এই আলোর মানুষটিকে নিয়ে শোকসভার আয়োজন করে গণজাগরণ মঞ্চ। বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই শোকসভায় ড. অজয় রায়কে নিয়ে কথা বলেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
শোকসভায় নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, অজয় এবং আমি সমবয়সী ছিলাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান সময় পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছি। আমরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং বুদ্ধিজীবী হিসেবেও অজয়ের ভূমিকা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পর নিজের অসুস্থ শরীর নিয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সে শামিল হয়েছে।
তিনি বলেন, দুঃখ এই যে, আমাদের শূন্যস্থানগুলো পূরণ হচ্ছে না। প্রকৃতির নিয়মে আমাদের সবাইকেই যেতে হবে, তবে শূন্যস্থান পূরণের মতো কাউকে দেখে যেতে পারলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। তরুণেরা ভয়ভীতি ঠেলে এগিয়ে এলে আমাদের এই প্রাণত্যাগ কোনো সমস্যা নয়। আর অজয় রায়কে স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে তার চেতনাকেও আমাদের ধারণ করতে হবে। দেশের নীতিনিষ্ঠ মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন তিনি।
ড. অজয় রায়ের ছেলে অনুজিৎ রায় বলেন, ছেলে হিসেবে পরিবারের বটবৃক্ষটাকে হারালাম। আর দেশ যে মেধাসত্ব হারালো, তা জাতি এখনো উপলব্ধি করতে পেরেছে কিনা জানি না। বাবা দেশকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। বিদেশে পাড়ি জমাবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো দেশ ছেড়ে যেতে চাননি।
তিনি বলেন, যুদ্ধপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে বাবা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তার ছেলে অভিজিৎ হত্যার বিচার তিনি দেখে যেতে পারেননি। আর তাকে নিয়ে শোকসভা শুধু শোকের জন্য নয়, তা যেন হয় তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। তার চিন্তা, কর্ম, মননশীলতা সবকিছুই আমাদের মধ্যে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, প্রতিবছর বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষককে স্মরণ করি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কম শিক্ষকই আছেন বা ছিলেন যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অজয় রায় তাদের মধ্যে একজন। তাকে খুব কমই বিচলিত হতে দেখেছি। তিনি একটি অপরূপ ও বীরের জীবন যাপন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সাহস কেমন হয়! তার মতো সেই সাহস নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক মারুফ রসূল বলেন, ড. অজয় রায় শুধু একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নয়, তিনি নিজের আত্মপরিচয় খুঁজেছেন একজন বাঙালি হিসেবে। সারাজীবন বিজ্ঞান মনস্কতা নিয়ে মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে কাজ করেছেন। তিনিই প্রথম পদার্থ বিজ্ঞানের বই বাংলায় অনুবাদ করেন। আর লেখক হিসেবে কম লিখলেও তা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি, তার কাজ ও তার স্মৃতির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানায়।
এ সময় তিনি ড. অজয় রায়ের বিভিন্ন লেখা একত্রিত করে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের জন্য আহ্বান জানান। একইসঙ্গে ঢাকার একটি সড়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে তার নামে নামকরণের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ছাত্রনেতা মানবেন্দ্র দেব বলেন, ড. অজয় রায় ছিলেন ঠাণ্ডা, স্থির এবং শক্ত স্বভাবের মানুষ। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে তার ভূমিকা অসামান্য। তিনি একাধারে একজন বিজ্ঞানী, মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রগতিশীলদের পক্ষের মানুষ। তার পরিচয় অজস্র। তিনি সবসময় নিজের মধ্যে দেশকে ধারণ করে রাখতেন।
লেখক ও প্রকাশক নবীন আহসান বলেন, একটি সময় অভিজিৎ রায়, ব্লগার দীপন, ব্লগার নিলয়ের মতো লেখক ও প্রকাশকরা যখন হত্যার শিকার হয়েছেন, তখন তিনি আমাদের মাথার ওপর থেকে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু তিনি তার ছেলে অভিজিৎ রায় হত্যার বিচার দেখে যেতে পারলেন না।
আয়োজনে গণসঙ্গীত ও শোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পীরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন খান আসাদুজ্জামান মাসুম।
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আক্রামুল হকের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আলম, ছাত্রনেতা মেহেদী হাসান নোবেল, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক শিবলী হাসান, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সংগঠক ও প্রকৌশলী সম্পা বসু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতা আল কাদেরী জয়, অ্যাডভোকেট জীবনানন্দ জয়ন্ত প্রমুখ।
ওই বক্তরা বলেন, ড. অজয় রায় আমাদের জন্য একটি লাইট হাউস। তার আলো মেখে আমাদের সামনের পথ চলতে হবে। তার জ্ঞান তার মাঝে কখনো গৌরব আনেনি, বিনয় এনেছে। আমাদের সেই শিক্ষার শিক্ষিত হতে হবে।
এর আগে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অধ্যাপক অজয় রায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায়ের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ফুসফুসের সংক্রমণের পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯
এইচএমএস/এএটি