ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৪৮ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
৪৮ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের

বাগেরহাট: উদাসীনতা, অবহেলা ও অযত্নে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বাগেরহাটের শরণখোলার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সমাধিস্থল। সংরক্ষণের অভাবে তার সমাধির আশপাশে বিভিন্ন লতাপতা জন্মেছে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা কবরের উপরেও ভেঙে পড়েছে ছোটখাট কয়েকটি গাছ। এভাবে চলতে থাকলে কোনো এক সময় হারিয়ে যাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের শেষ স্মৃতিটুকু।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা এই বীর শহীদের সমাধি সংরক্ষিত না হওয়া ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার সহযোদ্ধারা।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৪৪ সালে শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী সংলগ্ন দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার হোসেন।

আলেপ খান ও জুমিনা খাতুনের চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আনোয়ার ছিলেন সবার ছোট। ১৯৬৬ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে করাচি আর্মিতে যোগদান করেন তিনি। সর্বশেষ পাকিস্তানের খানে ওয়ালা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন পদে নিযুক্ত হন।  

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। চাকরির মায়া ত্যাগ করে, জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে শরণখোলাবাসীকে সংগঠিত করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সুন্দরবনে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাক-হানাদার ও রাজাকারদের সঙ্গে লড়াই করেন। তার নেতৃত্বে একাধিক হামলায় অনেক পাকিস্তানি সেনা সদস্য নিহত হন। রাজাকারেরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে তার সাহসী কার্যক্রম।  

তার ভাই হেমায়েত উদ্দিন খানও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তার সঙ্গে। অপর দুই ভাই শাফায়েত খান ও সায়েদ খান পাকিস্তান আর্মির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বন্দি ছিলেন পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি শরণখোলা থানা ঘেরাও করেন। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালায়। দুই পক্ষের গুলি বিনিময়ের সময় ক্যাপ্টেন আনোয়ার গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলে মারা যান।  

শহীদ ক্যাপ্টেন আনোয়ারের মরদেহ তার সহযোদ্ধা শেখ সামসুর রহমান ও মনিরুজ্জামান বাবুল গোপনে নৌকায় করে বাড়িতে পৌঁছে দেন। রাত ১২টায় বলেশ্বর নদীর তীরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থায় বিবাহ করলেও কোনো সন্তান ছিল না তার। যার ফলে মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীও চলে যান অন্যত্র।

এরপরে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সম্মানিত করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরপ্রতিক, বীর উত্তমসহ বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া হয় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের ভাই হেমায়েত উদ্দিন খানকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি ভাতাপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের খোঁজ নেয় না কেউ।

এরমধ্যে বলেশ্বরের ভাঙনে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের কবর। ২০১৫ সালে স্থানীয় সংবাদকর্মী নজরুল ইসলাম আকনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলার প্রশাসন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের দেহবাশেষ তুলে শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাজারস্থ শহীদদের সমাধিস্থলের অদুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। কিন্তু তারপর থেকে ওই সমাধিকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের কবরটি রয়েছে খোলা জায়গায় চরম অবহেলায়। চেনাই যাচ্ছেনা লতা-পাতায় আচ্ছন্ন তার সমাধিস্থল। গবাদি পশুর অবাধ বিচরণও রয়েছে সেখানে। এমনকি তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিকে দায়মুক্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের সহযোদ্ধা শেখ সামসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তিনি অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তার নেতৃত্বেই শরণখোলা থানা ঘেরাও করা হয়। ওই সময় সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আমরা তার মরদেহ খুব গোপনে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জেল হোসেন পঞ্চায়েত ও হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে জানান, যুদ্ধের সময় পাশে থেকেই ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের বীরত্ব দেখেছি। তিনিই শরণখোলা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক এবং শরণখোলার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তার প্রতি অবহেলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার শামিল। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সমাধিস্থল নির্মাণ করা এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ অবদান রাখায় তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করার দাবি জানাই।

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের ভাগ্নে শিক্ষক আ. খালেক হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, সেনাবাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হন মামা আনোয়ার হোসেন। কিন্ত অবহেলা ছাড়া কিছুই পাননি তিনি। এমনকি তার কবরের জায়গাটুকুও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। জানিনা কি স্বার্থে তার অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।  

ভাইয়ের কথা শুনেই কান্নাজড়িত কন্ঠে আনোয়ার হোসেনের বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বলেন, সেনাবাহিনীর অফিসার পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশের জন্য শহীদ হল আনোয়ার। আজ তার কোনো নাম নাই। মুক্তিযুদ্ধের কোনো অনুষ্ঠানেও কেউ তার নাম উচ্চারণ করে না। মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার ক্যাপ্টেন আনোয়ার। মৃত্যুর আগে একটাই দাবি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাইয়ের স্বীকৃতি চাই।

শরণখোলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার এমএ খালেক খান বাংলানিউজকে বলেন, শরণখোলা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক হলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। তৎকালীন ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টেরের দায়িত্ব প্রাপ্তদের অবহেলা উদাসীনতার কারণে এ শহীদের নাম নিশানা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। জানিনা এখানে কি রাজনীতি ছিলো। তাকে ভুলে যাওয়া, তার কবরস্থান হারিয়ে যাওয়া জাতির জন্য লজ্জাজনক। তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা খেতাব দেওয়া উচিত।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহিন জানান, শহীদ ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। তার প্রতি অবহেলা দেখানোর কোনো সুযোগ নাই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানানো হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।