তবে শুধু কৃষ্ণকাটির আশরাফ আলী শেখ নন, মারাত্মক আর্সেনিক ঝুঁকিতে পড়েছে গোটা তালা উপজেলা। সুপেয় খাবার পানির সংকটে আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত হয়ে গত ১৬ বছরে একই পরিবারের চারজনসহ অন্তত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বিষয়টি অস্বীকার না করলেও এ মুহূর্তে দপ্তরটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই বলে জানিয়েছে।
আশরাফ আলী শেখ বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রথম আমার হাত-পায়ে ফোঁটা ফোঁটা দাগ দেখা দেয়। একইসঙ্গে হাত-পায়ের তলায় জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু করে। প্রাথমিকভাবে হোমিও চিকিৎসা করালে জ্বালা-যন্ত্রণা কমে যায়। কিন্তু কিছুদিন ভালো থাকলেও পরবর্তীকালে আস্তে আস্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আর্সেনিকের বিষ।
চিকিৎসায় ত্রুটি না করলেও আর সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেননি তিনি। হঠাৎ একদিন মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে তার হাত-পা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। তখন স্থানীয় মুসুল্লিরা তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়িতেই ইবাদতের অনুরোধ করেন। এখন তার বাম হাত ও ডান পায়ের গোড়ালি ফুলে বৃহদাকারের ঘা দেখা দিয়েছে। যা বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
একইভাবে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, তালা উপজেলার কৃষ্ণকাটি গ্রামের জালাল মোড়লও দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। যা বর্তমানে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। এছাড়া তার বাবা আনসার মোড়ল, ফুফু শরভানু বিবি, বড়ভাই আলাউদ্দীন মোড়ল ও সালাউদ্দীন মোড়ল মারা গেছেন আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে। একইসঙ্গে তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত।
এছাড়া তালা উপজেলার তালা সদর, খেশরা, খলিষখালী ও জালালপুর ইউনিয়নে আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলের সংখ্যা সর্বাধিক বলে জানা গেছে। এ হিসেবে সবমিলে উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতে।
কৃষ্ণকাটি গ্রামের সাজেদা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমি নিজেও আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। আমার বিয়ের পর স্বামীর বাড়ির লোকজন যখন জানতে পারে আমি আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত, তখন আমাকে বিদায় করে দেয়। বাপের বাড়িতেই ভুগছি রোগে।
তিনি বলেন, আমাদের এলাকার আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, মুনছুর রহমান মোড়ল, শাহানারা বেগম, শরুপজান বিবি, সোনাবান বিবি, সোহরাব মোড়ল, ইয়াছিন মোড়ল, শরভানু বিবি, ছবেদ মোড়ল, ফকির মোড়ল, জবেদ আলী মোড়ল, কাশেম আলী শেখসহ অনেকেই আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
তাদের বাড়িতে কোনো আত্মীয়-স্বজন আসে না। তারাও কারাও বাড়িতে যেতে পারেন না বলে কষ্টভরে জানিয়েছেন সাজেদা বেগম।
স্থানীয়রা বলছে, কৃষ্ণকাটি গ্রামে ডিপ টিউবওয়েলে লবণ পানি ওঠে। এজন্য সবাই শ্যালো টিউবওয়েলের পানি খায়। যার বেশিভাগেই রয়েছে আর্সেনিক। মানুষ অহরহ আর্সেনিকযুক্ত পানি খাওয়াসহ অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করছে।
তালার জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আনারুল ইসলাম কৃষ্ণকাটি গ্রামে একই পরিবারের চারজনসহ অনেকেই আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন।
তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রাজীব সরদার বাংলানিউজকে বলেন, শুনেছি এই এলাকায় আর্সেনিকের প্রকোপ বেশি। কিন্তু সচরাচার কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে না।
তিনি বলেন, ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে আর্সেনিকোসিসের চিকিৎসা না করালে, তা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। একবার কোনো মানুষের শরীরে আর্সেনিকোসিস হলে, তা আস্তে আস্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যা ভালো হওয়ার লক্ষণ খুবই কম।
তালা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, তালার বেশকিছু এলাকায় আর্সেনিকের প্রকোপ রয়েছে। এসব এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল সাকসেসফুল না। এজন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা কঠিন। তবে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং করে দেওয়া হচ্ছে। যদিও বৃষ্টি সিজনাল হওয়ায় তা এতটা কাজে আসে না। এছাড়া রিভার্স অসমোসিস (আরও) এবং আর্সেনিক আয়রন রিমুভাল প্ল্যান্ট (এআইআরপি) পর্যাপ্ত না থাকায় তাও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রিভার্স অসমোসিস এবং এআইআরপি স্থাপনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২০
টিএ