অনুদানের যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল তা কেবল পাইলিং করতেই শেষ হয়ে গেছে। এখন পঠাগারের মূল কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করতে আরও দুই কোটি টকারও বেশি অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, ভারত সরকারের অনুদানে দু’টি গ্রন্থাগার ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে।
এ দুইটি গ্রন্থাগারের মধ্যে একটি হচ্ছে পদ্মা সাধারণ গ্রন্থাগার। অন্যটি রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার। এর মধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করে ১৩৪ বছরের পুরনো রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে এর নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং প্রত্নতত্ত্ব অবকাঠামো উন্নয়ন সাধন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজশাহী ও রাজশাহী মহানগরীর টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প’।
এ প্রকল্পের অধীনে রাজশাহীর পুরনো গ্রন্থাগারের জায়গায় ৫২ ফুট উঁচু পাঁচ তলা ভবনের সমান কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা। যেখানে গ্রন্থাগারের পাশাপাশি ৩০০ আসনের একটি উন্নত মানের মিলনায়তন নির্মাণের কথা রয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। ঐতিহাসিক এই ভবনের একটি রেপ্লিকা তৈরিরও কথা রয়েছে। যেন পরবর্তী প্রজন্ম সেখানে গিয়ে জানতে পারে আগের ‘রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি’র অবয়ব কেমন ছিল।
এর অধীন মহানগরীর মিয়াপাড়ায় থাকা সাধারণ গ্রন্থাগারের পুনর্নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ পার হয়ে গেলেও মূল পাঠগার কমপ্লেক্স ভবনের কাজ শুরুই করতে পারেনি ঠিকদারি প্রতিষ্ঠান ‘আরসিসি এল-আরইএমসি জেভি’। এর মধ্যে কেবল পাইলিং করতে গিয়েই অনুদানের সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর নতুন কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন বলছে, এর মধ্যে ভারত সরকারের অনুদানের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে সিটি করপোরেশন আরও ৭০ লাখ টাকা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
কিন্তু এর পরও মূল কমপ্লেক্স ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। কাজটি শেষ করতে আরও দুই কোটি টাকারও বেশি অর্থের প্রয়োজন। তারা বরাদ্দের চেয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছেন। টাকা পেলেই আবারও কাজ শুরু করা হবে।
এদিকে, সাধারণ গ্রন্থাগারের নতুন কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জন্য ঐতিহাসিক ভবনটি ভেঙে ফেলার পর এর অনেক দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান বই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। যদিও সংরক্ষণের জন্য বইগুলো আপাতত রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন ভবনে রাখা হয়েছে। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক বই চুরি যেতে বা হারিয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘ভারত সরকারের অনুদানের টাকায় রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের উন্নয়ন হচ্ছে--এটি ভালো। তবে আমার কাছে মনে হয়, এই টাকা আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগতে ব্যর্থ হচ্ছি। আর কেবল সাধারণ গ্রন্থাগারের পাইলিংয়ে এতো টাকা কীভাবে খরচ হলো তা তদন্ত করে দেখা উচিত। এছাড়া ভারত সরকারের অনুদানের প্রকল্প বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলেও আমি মনে করি’।
তবে সাধারণ গ্রন্থাগারের ৭০ ফুট পর্যন্ত ১১৩টি পাইলিং করতে হয়েছে, যা প্রাক্কলনের পুরোপুরি বাইরে ছিল বলে দাবি করেছেন রাজশাহী সিটি করপোশেনের (রাসিক) প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল হক।
তিনি বলেন, আগে ধারণা করা হচ্ছিল যে, শুধু কলামের ওপরেই পাঠাগার কমপ্লেক্স ভবনটি নির্মাণ করা যাবে। এই প্রাক্কলন ব্যয়ের ওপর ধারণা করেই ভারত সরকারের অর্থ বরাদ্দ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ওই জায়গার মাটির মান খারাপ। তাই পাইলিং করতেই হবে।
এরপর সাধারণ গ্রন্থাগারের স্থানে ৭০ ফুট পর্যন্ত ১১৩টি পাইলিং করতে হয়েছে। এতেই ভারত সরকারের অনুদানের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। এর সঙ্গে সিটি করপোরেশনের আরও ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। কারণ তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল প্রকল্প শেষ করতে যদি বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা সিটি করপোরেশনই দেবে।
তাই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও তারা এটি বাস্তবায়নে আরও ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছেন। বর্তমানে প্রকল্পটির অর্থ বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, এক মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাবে। আর ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থ বরাদ্দ পেলে পয়লা মার্চ থেকে আবার কাজ শুরু হবে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান প্রকৌশলী।
রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার:
১৩৬ বছর আগে, ১৮৮৪ সালের ৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার। এরপর থেকে বহু দুষ্পাপ্য ও দুর্লভ বই ও ম্যাগাজিনে ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়েছে এই গ্রন্থাগার। মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে নামি-দামি বহু বরেণ্য মানুষের আগমন ঘটেছে এখানে। রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারে যাতায়াত ছিল এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, সরোজিনী নাইডু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯২৯), ড. মো. শহীদুল্লাহ, জলধর সেন, জে জিড্রমান্ড, স্যার আজিজুল হক, রজনীকান্ত দাস, প্রফুল্ল কুমার সরকার, গডফ্রেজ যখমন, শিশির ভাদুড়ী প্রমুখ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রন্থাগারটি পরিণত হয়েছিল রাজশাহী শহরসহ আশপাশের অঞ্চলের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে।
স্কটল্যান্ড থেকে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার গ্রন্থাবলির প্রথম সংস্করণ, অ্যানুয়াল রেজিস্ট্রার, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র প্রথম সংস্করণ,বৃটিশ আমলের পত্রিকা ভারতবর্ষ, শনিবারের চিঠি, বসুমতি, রিভিউয়ের মতো সব বই ও পত্রিকা রয়েছে এখানে। যে কারণে বহু গবেষকই নিয়মিত এসেছেন এই গ্রন্থাগারে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের কাশিমপুর হাউসে ছিল এই গ্রন্থাগার।
পরে মিয়াপাড়ায় ভবন ও জমি পাওয়ার পর ১৮৮৪ সালে গ্রন্থাগারটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ১৮৭১-৭২ সালে এই গ্রন্থাগারে বই ছিল ৩ হাজার ২৪৭টি, সাময়িকী ছিল ছয়টি। এই গ্রন্থাগারের শতকরা ৫০ ভাগ বই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ। এর বয়স ১৩৬ বছর হলেও এখানে ২০০ বছর পুরনো বইও আছে। পাঠগার পরিচালনায় এখন শুধু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে বছরে ৬০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সময় : ০৯৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০২০
এসএস/জেএম