অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তভার পাওয়ার পর একে এক জট খুলতে শুরু করে মামলাটির। মাত্র ছয় মাসের তদন্তে ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি।
পিবিআই জানায়, ঘটনার বাদি-বিবাদির কেউ না হওয়া স্বত্ত্বেও মারুফ রেজা নামে একজন আদালতে মামলার স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করেন। তদন্তের শুরুতে তৃতীয় পক্ষের ওই ব্যাক্তির আবেদনের বিষয়টি খটকা লাগে পিবিআই’র কাছে। যার প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ী মারুফ রেজার সঙ্গে ছদ্মবেশে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন কারণের অজুহাতে দেখা করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। একপর্যায়ে তদন্তে সগিরা হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।
মারুফ রেজাই সরাসরি সগিরাকে গুলি করে হত্যা করেন। যার প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এভাবেই জট খুলে যায় সগিরা হত্যাকাণ্ডের। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরীর পরিকল্পনাতেই খুন হন সগিরা মোর্শেদ।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ঘটনার পুরোপুরি ৩০ বছর পর মামলাটির তদন্তভার পায় পিবিআই। তদন্তভার পাওয়ার পর তিন ধাপে মোট ছয় মাস পর চারজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হচ্ছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর এটিকে একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। হত্যাকাণ্ডে চারজনের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন- নিহত সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন, হাসান আলীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান চারটি আলামতের একটিও পাওয়া যায়নি। আলামতগুলো হচ্ছে- সগিরাকে বহনকারী রিক্সা, তার রক্তাক্ত কাপড়, খুনিরা যে মোটরসাইকেলে চড়ে এসেছিলেন সেটি এবং যে রিভালবারটি দিয়ে সগিরাকে গুলি করা হয়।
এসব আলামতের বিষয়ে পিবিআই জানায়, হত্যাকাণ্ডে একটি সিডি-৫০ মডেলের মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়। যার মাধ্যমে ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান চড়ে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোটরসাইকেলটি একটি গ্যারেজে বিক্রি করা হয়েছিল, যেটি পরবর্তীতে চুরি হয়ে যায়। ওই গ্যারেজ সংশ্লিষ্ট আনোয়ার হোসেন স্বাক্ষি হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রিভালবারটি হরর মুন্না নামের একজনের কাছ থেকে এনেছিলেন মারুফ। হরর মুন্না ২০০৫ সালের ২৮ নভেম্বর রূপগঞ্জে এক বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। সে সময় তার কাছ থেকে একটি রিভালবারসহ দুইটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। মামলাটি নিস্পত্তি হওয়ায় উদ্ধারকৃত সেই রিভালবারটিই সগিরা খুনে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সগিরা মোর্শেদের ভাড়াকৃত রিক্সাটি জব্দ করে ফজলুল করিম নামে একজনের জিম্মায় দেয় তৎকালীন ডিবি কর্মকর্তারা। কিন্তু নথিতে ফজলুল করিমের ঢাকা ও নোয়াখালীর ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সগিরার রক্তাক্ত পোশাক অ্যাডভোকেট শহিদ উদ্দিন নামে একজনের উপস্থিতিতে আদালতের মালখানায় দেওয়া হয়। আদালতে অ্যাডভোকেট শহিদ উদ্দিনের খোঁজ করে একজন এই নামে মারা গেছেন বলে জানা গেছে। তবে তিনিই সেই ব্যক্তি কিনা নিশ্চিত হতে পারেনি পিবিআই। এদিকে, কয়েকদফা চেষ্টার পর নিহত সগিরার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং সুরতহাল প্রতিবেদন সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ঘটনার বিবরনীতে জানা যায়, পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন ও হাসান আলীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন আনাস মাহমুদ ও ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা। মারুফ রেজা হাসান আলীর রোগী ছিলেন। এ খুনের জন্য হাসান আলীর সঙ্গে মারুফের ২৫ হাজার টাকার চুক্তি হয়। খুনের কয়েকদিন পর মারুফকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন হাসান আলী। বাকি ১০ হাজার টাকা আর পরিশোধ করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, তৎকালীন ২৫ হাজার টাকা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার স্বামী সালাম চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক জড়িত দুজনের কথা বললেও মিন্টু ওরফে মন্টু নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। নেওয়া হয় সাতজনের সাক্ষ্য। বাদীপক্ষের সাক্ষ্যে আসামি মন্টু ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নাম আসে। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।
এ আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজা হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়ে অধিকতর তদন্তের আদেশ স্থগিত করেন। পরের বছরের ২৭ আগস্ট অপর এক আদেশে হাইকোর্ট ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান। এতে থমকে যায় মামলার কার্যক্রম।
বিষয়টি নজরে এলে ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৬ জুন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ মামলার অধিকতর তদন্ত আদেশে ইতিপূর্বে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে ওই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
পিবিআই জানায়, ইতোপূর্বে ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা এই মামলায় গড়ে একজন করে বিভিন্ন সময় মোট ২৫ জনকে গ্রেফতার করেন। যাদের সবাইকে মামলা থেকে অব্যাহতির কথা বলা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
ইতোপূর্বে ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে ঘটনার রহস্য উদঘাটন সম্ভব না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট কেউ নয়। মামলটি যখন পিবিআইয়ের কাছ আসে তখন আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিই। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) পিবিআই আদালতে ১৩০৯ পৃষ্ঠার চার্জশিট দাখিল করেছে, যার মধ্যে ৬০৭ পৃষ্ঠা পিবিআই সংযোজিত। মামলায় ইতোমধ্যে আট জন স্বাক্ষি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আসামিদের প্রত্যেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যা একটার সঙ্গে আরেকটি মিলে যায়। এছাড়া, আটজন স্বাক্ষ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও মামলার গুরুত্বপূর্ণ চারটি আলামত খুঁজে পাইনি। তবে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ডকুমেন্টস আমরা উপস্থাপন করছি। সাক্ষিদের জবানবন্দিতেও বিষয়গুলো উঠে এসেছে। আশা করছি আমরা আদালতকে বিষয়গুলো বোঝাতে সক্ষম হবো এবং যার মাধ্যমে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২০
পিএম/এমএমএস