অটিস্টিক শিশুর হতাশ অভিভাবকদের আশার আলো দেখাতে এমনই একটি স্কুল রয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের চানমারী মোড়ে। স্কুলটির নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক অটিস্টিক বিদ্যালয়’।
বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কেউ হাঁটতে পারে, কেউ পারে না। আবার কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কারো হাত বাঁকা, কারো পা বাঁকা আবার কেউ সঠিকভাবে কথাও বলতে পারে না। আরও কয়েকজন আছে যারা মা-দাদী বাবার কোলে আসা যাওয়া করে। ক্লাস শুরুর আগেই কেউ কারো সহযোগিতা না নিয়ে একাই লিখতে পারছে। কেউ আবার পাশের বন্ধুর সহযোগিতায় লিখছে। তবে তারা প্রত্যেকেই পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে এখন অনেক সচেতন। এসব শিশুদের স্বেচ্ছাশ্রমে পরম স্নেহ ও মমতা দিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা।
জানা যায়, ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী শিশুদের কথা চিন্তা করে ২০১৩ সালে ‘রান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’র সহায়তায় কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য, তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। সাড়ে ১৪ শতাংশ ভূমি দান করেন ওই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার ভাই ফজলুর হক। তবে স্কুলটি কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা মেলেনি।
প্রতিষ্ঠানটিতে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন- পাবনা অ্যাডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষার্থী কানিজ ফাতিমা জলি, বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষার্থী শারমিন খাতুন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষার্থী শিল্পী খাতুন, স্নাতক ডিগ্রিধারী বর্না বেগম, ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সোহেল রানার মতো অনেকেই।
ঈশ্বরদী পৌর এলাকার পিয়ারপুর গ্রামের দিনমজুর সাইদুর রহমানের মেয়ে সিনথিয়া। সে জন্মের পর থেকে বড় হয়ে বসতে পারতো না। পরে উন্নত চিকিৎসার পর সে বসতে পারে। অন্য স্কুলে গিয়ে সে কারো সঙ্গে কথা বলতো না। এখন সে প্রতিদিন স্কুলে আসে, নিজে সুন্দর করে লিখতে পারে, পড়তে পারে।
সাঁড়া ইউনিয়নের মাজদিয়া পশ্চিম খাঁপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শেফালী খাতুন বাংলানিউজকে জানান, ইচ্ছে হলেও ছেলেকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। কারণ আমরা হতদরিদ্র! বাড়ি থেকে আসতে প্রতিদিন ৩০/৪০ টাকা খরচ হয়। একটি স্কুলভ্যান থাকলে আমার আর আসার প্রয়োজন হতো না।
বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য, এমদাদুল হক সোহাগ বাংলানিউজকে জানান, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবনা-৪ আসনের সংসদ, সদস্য, সাঁড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ ঈশ্বরদী উপজেলা যুবলীগ সভাপতিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিদ্যালয়টি।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ফজলুর হক বাংলানিউজকে বলেন, অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করা অনেক কষ্টের। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ওদের শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে। আগের চেয়ে তাদের উন্নতি হচ্ছে। যারা কারো সঙ্গে মিশতো না এখন তারা উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। শুধু এই প্রতিষ্ঠানেরই কেবল উন্নতি হচ্ছে না। এ স্কুলে বর্তমানে ১২৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ১৪ জন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুকুর আলী টুটুল বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বিদ্যালয়টি সরকারি অনুদান পাচ্ছে না। শিক্ষকরাও বেতন ভাতা না পেয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। বর্তমানে স্কুলটিতে সরকারি নজর পড়া খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঈশ্বরদী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিহাব রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, অটিস্টিক শিশুরা সমাজের বোঝা নয়, এদেরও আছে শিক্ষার অধিকার। উপযুক্ত শিক্ষা পেলে তারাও সমাজের জন্য কিছু করবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
উল্লেখ্য, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌকায় করে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে নৌকায় করে পার করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধের গেজেটে তার নাম অন্তর্ভুক্ত না হলেও তার স্মৃতি ধরে রাখতে এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২০
এনটি