ফেনী প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার চারটি উপজেলায় আটটি বালু মহাল রয়েছে। এর মধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় মহুরী নদীর যে বালু মহালটি রয়েছে, তার আয়তনের পরিধি ১০ একর থেকে বেড়ে ১২৯ একর দাঁড়ালেও দীর্ঘ প্রায় ১২ বছরে নেই কোনো ইজারা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৪২৬ বাংলা বছরের জন্য এ মহালটির ইজারা মূল্য ধরা হয় ৪৪ লাখ টাকা। এতে দেখা যাচ্ছে ইজারা না হওয়ায় গত ১২ বছরে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ মহালটি ইজারার জন্য প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেরা যেমন কোনো দরপত্র দাখিল করে না, আবার অন্যদেরও দরপত্র জমা দিতে বাঁধা দেয়। এ সুযোগে বিনা ইজারায় ওই প্রভাবশালী চক্রটি অবৈধভাবে উত্তোলন করে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার বালু। এ মহালটির মৌজার নাম ১২৪ নম্বর পূর্ব শিবপুর, ৭৩ নম্বর কচুয়া এবং ১২৫ নম্বর ফাজিলপুর। এ তিনটি মৌজার বালু মহালের আয়তন ১২৯ একর।
ঠিক এমনভাবে জেলায় বিভিন্ন নদী ও খালগুলোতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবুও অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের অথবা স্থানের সঠিক কোনো তালিকা নেই সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই। জেলা প্রশাসনের তালিকায় আটটি বালু মহাল থাকলেও, প্রায় ৩০/৩৫ স্থান থেকে তোলা হয় বালু।
জেলার বৈধ সাতটি বালু মহালের একটি হলো পরশুরামে মুহুরী নদীর বালু মহাল (১ নম্বর অংশ)। এটি ২১ নম্বর বাউরখুমা মৌজায় অবস্থিত। এ মহালটির মোট আয়তন পরিমাণ প্রায় ৩৩ একর। চলতি বছর (১৪২৬ বঙ্গাব্দ) ইজারা দেওয়া হয়েছে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। ইজারাদার শাপলা ট্রেডার্স, প্রোপ্রাইটর- মীর আহম্মদ চৌধুরী।
ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফেনী নদী বালু মহালের অংশ। ১০৪ নম্বর নাঙ্গলমোড়া মৌজায় এর অবস্থান। এ মহালটির মোট আয়তন প্রায় ২৪ একর। চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ২৬ হাজার টাকায়। ইজারাদার মাহি এন্টারপ্রাইজ, প্রোপ্রাইটর- দিদারুল আলম ভূঞা।
ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফুলছড়ি বালু মহালের অংশ। ৯ নম্বর দক্ষিণ যশপুর মৌজায় এর অবস্থান। এ মহালটির মোট আয়তন প্রায় ৩ একর ১১ শতাংশ। চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে সাত লাখ টাকায়। ইজারাদার মিজান টিম্বার অ্যান্ড ফার্নিচার, প্রোপ্রাইটর-মিজানুর রহমান।
ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফেনী নদী বালু মহালের আরেক অংশ। দিয়ারা ১১৭ নম্বর জয়চাঁদপুর মৌজায় এর অবস্থান। এ মহালটির মোট আয়তন প্রায় ১৫ একর। একই উপজেলার ১১১ নম্বর উদয় মহাজনের চর, ১২২ নম্বর তিলকের চর, ১১৩ নম্বর জয়পুর মৌজার বালু মহালগুলো চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে ৪৪ লাখ ১০ হাজার টাকায়। মহালগুলোর ইজারাদাররা হলেন- রওশন আরা এন্টারপ্রাইজ, প্রোপ্রাইটর-রফিকুল হায়দার চৌধুরী।
একই উপজেলার মহামায়া ছড়া বালু মহাল, ৭ নম্বর উত্তর সতর মৌজায় অবস্থিত। চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। ইজারাদার-এ হক ট্রেডিং এজেন্সি, প্রোপ্রাইটর-আজিজুল হক।
সোনাগাজীর সোনাপুর বালু মহাল। ৭ নম্বর সোনাপুর, ৬৯ নম্বর থাকখোয়াজের লামছি মৌজায় অবস্থিত। চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে ২৭ লাখ টাকায়। ইজারাদার-প্রত্যয় এন্টারপ্রাইজ, প্রোপ্রাইটর-মুজিবুল হক।
একই উপজেলায় চর দরবেশ উপজেলার বালু মহাল। ৯২ নম্বর চর দরবেশ মৌজায় অবস্থিত। চলতি বছর ইজারা দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। ইজারাদার-মেসার্স সোনাগাজী ট্রেডার্স, প্রোপ্রাইটর-মোশারফ হোসেন।
বালু মহালগুলো সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকার থেকে যে নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে, তা অতিক্রম করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো যে কোনো স্থান থেকে ইজারাদাররা প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করে চলেছেন। বিভিন্ন সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করলেও কোনোভাবেই অবৈধ বালু উত্তোলন থামানো যাচ্ছে না।
ছাগলনাইয়া উপজেলার ১২১ নম্বর উদয় মহাজনের চর যাহা শুভপুর ব্রিজের আশপাশের এলাকা। দরপত্রের শর্তে শুভপুর ব্রিজের আধা কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন করা যাবে না নির্দেশনা থাকলেও, ইজারাদার তা অমান্য করে ব্রিজের আশপাশ থেকে বালু উত্তোলন করায় শত বছরের ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত শুভপুর ব্রিজটি আজ হুমকির মুখে।
এদিকে, সোনাগাজী উপজেলার সোনাপুর বালু মহাল যে এলাকায় মুহুরী প্রজেক্ট রয়েছে সে এলাকায় বালু অবৈধ বালু উত্তোলন করায় সোনাগাজী উপজেলা প্রশাসন ইজারাদারদের অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। অপরদিকে, পরশুরামের মুহুরী নদীর বালু মহালের সীমানা অতিক্রম করে ইজারাদার অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ইজারাদারের বাইরেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নদী ও খালগুলো থেকে বালু তুলে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের ফসলি জমি ও বসতভিটা।
এদিকে, জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা। জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সরকারি ইজারার বাইরে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণার পরপরই অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ১০টি ড্রেজার ও পাম্প মেশিন জব্দ এবং একজনের দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সূত্র জানায়, ১৩ জানুয়ারি সকালে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাজিব দাস পুরকায়স্থ ও সজল কুমার দাস সোনাগাজীতে নদী এলাকায় অভিযানে বের হন। মুহুরী বাঁধের তিন কিলোমিটার উত্তরে ছয়টি অবৈধ ড্রেজার মেশিন জব্দ করা হয়। অভিযান টের পেয়ে বালু উত্তোলনকারীরা পালিয়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাহেবের ঘাট ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে নৌকায় পাম্প বসিয়ে বালু উত্তোলন করার সময় চারটি পাম্প মেশিন জব্দ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত দেব। অভিযানকালে জাহাঙ্গীর নামে একজন আটক করা হয়। পরে তাকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবী জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলেন, অবৈধ বালু উত্তোনকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. গোলাম জাকারিয়া বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়েছে এবং এটি চলমান থাকবে। অনেক সময় জনবল কম থাকায় জেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করতে হিমশিম খায়। এ সুযোগে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। জেলা প্রশাসন তাদের দমনে তৎপর। ইতোমধ্যে তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহির উদ্দিন বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো তালিকা আমাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগও নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো ছাড় নয় বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান। তিনি বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে অনেক জায়গায় বাড়িঘর, ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। তাই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২০
এসএইচডি/এফএম