চারপাশে ঘেরা মাটির দেয়াল তাও আবার একাধিক জায়গায় ফাটল, উপরে বাঁশ, মরিচা ধরা পুরাতন টিন আর তাল পাতার চাল। নেই কোনো কাঠ বা লোহা।
সবাই সুখী হতে চায়। পৃথিবীতে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে সুখী হতে চায় না। অনেকেই ভাবেন- অর্থ-কড়ি, শিক্ষা-দীক্ষা, বিবাহ, সন্তান-সন্তুতি, পরিবার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি মানুষকে সুখী করতে পারে। সুখ পেতে আসলে বহুতল বাড়ি লাগে না। ছোট্ট চিলেকোঠা বা মাটির ঘরেও পাওয়া যায় সুখ। এটিই প্রমাণ করে দিলেন হালিমন বিবি।
হালিমন বিবি। বয়স জিজ্ঞেস করতেই বললেন ৩০ বছর। স্বামী মারা গেছেন কত বছর হবে তাও বলতে পারেন না। তিনি নিজেকে ৩০ বছরের তরুণী দাবি করলেও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী জন্ম তারিখ ১৭ মে ১৯১৮। তাতে তার বয়স হয় ১০১ বছর ১০ মাস। সরকারি জমিতে স্বামীর রেখে যাওয়া মাটির ঘরই তার সম্বল। এলাকার অনেক মানুষই হালিমনের অসহায় জীবনযাপন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিষখালী নদী সংলগ্ন কাকচিড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ রুপদোন গ্রাম। যেখানে দারিদ্রসীমার নিচের মানুষের বসবাসের সংখ্যাই বেশি। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। একটা সময় ছিল গ্রামে মাটির ঘরেই বসবাস করতেন প্রান্তিক জনপদের মানুষ। এখন মাটির ঘর তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সরেজমিন ঘূরে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধের পাশেই হালিমনের মাটির ঘর। তার পাশেই বিষখালী নদী থেকে শাখা খালের পানি প্রবাহের জন্য স্লুইজ গেট। যেখানে জোয়ার-ভাটার শো-শো শব্দে ঘুম ভাঙে হালিমন বিবির। মাটির ঘরের চারপাশের দেয়ালের একাধিক জায়গায় ফাটল ধরার কারণে ভয়ে ভয়ে তাকে রাত্রীযাপন করতে হয়।
গ্রামের মানুষ হালিমন বিবিকে কখনো ‘বুড়ি মা’, কখনো ‘বুড়ি দাদি’ আবার কখনো ‘হালিমন বুড়ি’ বলে ডাকেন। সবাই তাকে ভালোবাসেন। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় দিনযাপন করেন তিনি।
তার দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে আমজাদ হোসেন কয়েক বছর আগে মারা গেছেন, আরেক ছেলে নুর মোহাম্মদ নিজের সংসার নিয়েই ব্যস্ত।
স্বামী মারা গেছেন কবে জিজ্ঞেস করতেই হালিমন বিবি বলেন, কইতে পারিনা। তবে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হালিমন বিবির স্বামী ফেরেস্তালী মারা গেছেন ৫০ বছর আগে।
কথা হয় সেই আলিশান বাড়ির বাসিন্দা হালিমন বিবির সঙ্গে। ঘরে উঠতেই জিজ্ঞেস করা হলো দুপুরে কি খেয়েছেন। তরকারির কড়াইয়ের ঢাকনা উঠিয়ে একটি ডিমের অর্ধেক আর ভাতের হাড়ির দুই মুষ্ঠি চালের ভাত দেখিয়ে বলেন, খাইছি, আর যা আছে রাইতে খামু।
রহস্য করে এ প্রতিবেদক আমাদের ভাত খাওয়াবেন হালিমনকে বললে তিনি বলেন, হয় খাওয়ামু না... আমনেরা বয়ন (বসেন) মুরহা (মুরগী) রাইন্দা (রান্না) কইরা খাওয়ামু। এতেই হালিমন বিবি প্রমাণ করে দিলেন, টাকা না থাকলে কি হবে বড় একটা মন আছে তার।
একমাত্র ছেলে নুর মোহাম্মদ দেখাশুনা করে কিনা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, পোলায় মোরে জিগায় না, মুই ভিক্ষা কইরা খাই।
হালিমনের ঘরে ঢুকতেই দেখা যায়- কত ভয়াবহ এবং অসহায়ত্ব নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। একটি মাত্র চৌকি, তাও আবার বাঁশের উপরে কাঠের মাচা দেওয়া। দেখা মেলেনি লোহার কোনো বস্তু। চৌকির উপরেই ঘুমানোর জন্য পাতলা কম্বল আর মশারি।
প্রতিবেশী শাহজাহান বিশ্বাস ও নুরু হাওলাদার বলেন, হালিমন বিবি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সারাদিন ঘুরে দু এক কেজি চাল পায় তা দিয়েই চলে। আর আমরা মাঝে মধ্যে লবণ, মরিচ হলুদ দেই।
হালিমন বিবির ছেলে নুর মোহাম্মদ বলেন, আমিও অসহায়, বৃদ্ধ হয়ে গেছি। দিনমজুরী করি তা দিয়ে নিজের সংসারই চলা দায়।
তবে মাঝে মাঝে মাকে দেখাশুনা করেন বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয় পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে এবং পরবর্তীতে সরকারি ঘরের অনুদান এলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হালিমন বিবিকে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২০
আরএ