ফেনী: তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। ব্যস্ত শহরে মানুষের আনাগোনাও শুরু হয়নি।
কাছে গিয়ে দেখা যায়, যারা জটলা পাকিয়েছেন, তাদের কেউই এ শহরের বাসিন্দা কিংবা স্থানীয় নয়; দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন। তারা জড়ো হয়েছেন নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগে ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্র ট্রাংক রোড খেজুর চত্বর ও দোয়েল চত্বরে জমে ওঠে শ্রম বেচাকেনার এ হাট।
এখানে পণ্যের মতো দর কষাকষি করে কেনাবেচা হয় মানুষের শ্রম, এ যেন হাল আমলের দাসপ্রথা। আদিকালে প্রায় সব শাসন ব্যবস্থাতেই দাসপ্রথা ছিল। তখন গবাদিপশুর মতো মানুষও কেনাবেচা হতো। তখনকার সময় বনেদি সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ও গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে এ প্রথা সরাসরি যুক্ত ছিল। সমাজের বিত্তবান ও শক্তিশালী শ্রেণি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির লোকদের দাসে পরিণত করতো।
সময় পাল্টেছে। কিন্তু এখনো যেন টিকে আছে হাজার বছরের পুরোনো সেই প্রথা। পণ্যের মতো দর কষাকষি করে বেচাকেনা হচ্ছে মানুষের শ্রম!
হাটে আগতদের সঙ্গে কথা বলেন জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট, দিনাজপুর, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন তারা। তাদের কেউ নদীভাঙনের শিকার, কারো আবাদি জমি নেই, কেউবা প্রান্তিক কৃষক। এসময় সেখানে কাজ না থাকায়, একটু বাড়তি রোজগারের আশায় তারা এখানে এসেছেন। প্রতিদিন ভোর না হতেই কাজের আশায় জড়ো হন শহরের ব্যস্ততম এ স্থানে। চলতে থাকে অন্য পণ্যের মতো দর কষাকষি। শ্রমজীবীরা দাম বেশি পান। তবে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে এখন শ্রমের দাম তেমন নেই বলে জানান অনেকে।
কথা হয় খুলনার বাগেরহাট থেকে আসা ফজলুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, তিন বছর আগে প্রথম তিনি ফেনীতে আসেন। এরপর থেকে যাওয়া আসার মধ্যেই রয়েছেন। সর্বশেষ দু’মাস আগে এসেছেন। দাম ভালো নয়, আগেরদিন দিনপতি সাড়ে ৪শ’ টাকায় কাজ করলেও আজ সে দামও উঠছে না।
একই এলাকার সেলিম হাওলাদার বলেন, ভাগ্য ভাল থাকলে দু’মাস কাজ করলে হাজার দশেক টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়। আবার কখনো কাজের অভাবে না খেয়েই থাকতে হয়। সবই কিসমত।
সিলেটের হবিগঞ্জ এলাকার নাসির উদ্দিন বললেন তার দুঃখের কথা। মানুষ কিনে নিয়ে গতর খাটিয়ে কাজ করায়, ঠিকমতো খেতেও দেয় না। শোয়ার জন্য যেখানে রাখে সেখানে বৃষ্টির পানি ও কুয়াশা পড়ে। এসব বলতে বলতে নাসির উদ্দিনের দু’চোখের কোণে পানি জমতে থাকে। তিনি বলেন, ‘ভাই দেশ থেকে কি করোনা যাইবো না? আমারা তো আর পারি না, মানুষ কাজে নিতে চায় না, না খেয়ে থাকি। গরিব হয়ে জন্মাইলে কষ্টের শেষ নাই। ’
নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকা থেকে কাজের খোঁজে এখানে এসেছেন নুর আলম। তিনি জানালেন আমন ধান কাটার মৌসুম চলছে। হাটে প্রচুর শ্রমিক থাকলেও চাহিদা তেমন নাই। আর সেকারণে দামও পড়তি।
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ থেকে এসেছেন কাউসার। কথা বলে জানা গেলো, কিছুদূর পড়াশোনাও করেছেন তিনি কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে মজুর খাটতে এসেছেন এ জেলায়। তিনি জানান, এ হাটে কয়েক ধরনের শ্রমিকের বেচাকেনা হয়। কেউ ধান কাটে, কেউ মাটি কাটে, আবার কেউ রাজমিস্ত্রির বেইজড, ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করে। কাজ ভেদে দামও ভিন্ন। সাধারণত রাজমিস্ত্রির সঙ্গে ঢালাই ও বেইজড এর কাজে মজুরি ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ হয়। ধানকাটা ও মাটিকাটায় ৩শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা।
প্রতিদিন একই স্থানে এসে জড়ো হওয়ার সুবাদে নিজেদের মধ্যে হৃদ্যতা তৈরি হয় শ্রমিকদের মধ্যে। কখনো কয়েকজন মিলে দল ধরেন, আবার কখনো দুয়েকজন মিলে গল্প-আড্ডায় মাতিয়ে রাখেন নিজেদের। শ্রমিকদের এ হাট ঘিরে সকালে জমে ওঠে শীতের পিঠা, পান সিগারেট ও চায়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান।
ফেনীতে সাধারণত ধানকাটা ও ধানের চারা রোপণের মৌসুমে শ্রম বিক্রির জন্য ভিড় করেন শ্রমজীবী মানুষ। ধানকাটা ও রোপণের মৌসুমে তাদের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় মজুরিও বাড়ে সমান তালে। সঙ্গে দু’বেলা খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা।
স্থানীয়রা জানান, বাজারে শ্রম বেচতে আসা এসব শ্রমজীবী মানুষ যেদিন শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, সেদিন তাদের রাত কাটে শহরের দোকান, বিপণিবিতান, মসজিদ, মাদরাসা কিংবা স্কুলঘরের বারান্দায়। কখনো আধপেটে বা কখনো উপোষ করে রাত কেটে যায় তাদের। সকাল হতেই আবার শ্রম বিক্রির আশায় ছুটে যান হাটে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২০
এসএইচডি/এফএম