ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভালো নেই ‘গয়না গ্রামের’ কারিগররা (ভিডিওসহ)

সাগর ফরাজী, সাভার করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০২০
ভালো নেই ‘গয়না গ্রামের’ কারিগররা (ভিডিওসহ)

সাভার (ঢাকা): সাধু চরণ, বয়স ৫৭ কি ৫৮ হবে। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া গহনা (গয়না, অলঙ্কার) তৈরিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

এ কাজ তিনি করছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে।  

৪০ বছরের মধ্যে গত ৩৫ বছরই তিনি রুপার অলঙ্কার তৈরি করেছেন। যুগ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, রুচি ও চাহিদা পাল্টে যাওয়ায় গত পাঁচ বছর ধরে তিনি পিতল ও তামা দিয়ে ইমিটেশন বা সিটি গোল্ডের (স্বর্ণের মত দেখতে) বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরি করছেন।  

দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সাধু চরণের সংসার। সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে তার একটি ছোটো গয়নার দোকান রয়েছে। শুধু তারই নয়, এখানে প্রায় অর্ধশত দোকান রয়েছে অলঙ্কারের৷ তার দোকানের গয়না বিক্রির টাকা দিয়ে তার পুরো পরিবার চলে। করোনা পরবর্তী সময় বর্তমানে তার দোকানে আগের মত বিক্রি নেই।

করোনাকালে প্রায় তিন মাস দোকান বন্ধ ছিল। সেই সময় সংসার চালাতে সব জমানো টাকা খরচ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে ঋণ করে পরিবার চালিয়েছেন। সব মিলিয়ে এখন দোকানে প্রতিদিন যে গয়না বিক্রি হয়, তা দিয়ে কোনো মতে চলছে সাধু চরণের সংসার।  
সাধু চরণ বাংলানিউজকে বলেন, আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও এ গ্রাম রুপা গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। কারণ দেড়শ’ বছর আগে থেকে এ এলাকার মানুষ রুপা দিয়ে নানা আকর্ষণীয় গয়না তৈরি করছেন। কিন্তু বর্তমানে রুপার গয়না আর তেমন কেউ ব্যবহার করেন না। ফলে রুপা গ্রাম নামটি বিলুপ্ত হয়েছে। এখন এ গ্রাম গয়না গ্রাম নামে পরিচিত। বর্তমানে তামা ও পিতলের গয়নার চাহিদা বাড়ছে। আর রুপার চেয়ে তামার দামও তুলনামূলক কম। ফলে রুপার অলঙ্কার তৈরি না করে দোকানে এখন তামা-পিতলের অলঙ্কার গুরুত্ব পাচ্ছে।  

সাভার উপজেলার ভাকুর্তা ইউনিয়নের গয়না গ্রামের গিয়ে কথা হয় সাধু চরণের মতো আরও অনেক কারিগরের সঙ্গে। সেই কথপোকথনে উঠে এসেছে কারিগরদের বর্তমান হালচাল।

সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, কারিগররা বালা, চুড়ি, দুল, মালা, হার, নুপুর, বিছাসহ  নানা গয়না তৈরিতে ব্যস্ত। আর দোকানে বাহারি ডিজাইনের গয়না তৈরি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতারা আসছেন আর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।  

কারিগর ও ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে ক্রেতাদের চাহিদার কারণে গয়না তৈরির কাঁচামাল বদলাতে বাধ্য হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রুপার দাম বেশি হওয়ায় বাজার দখল করে নিয়েছে অবিকল সোনা বা রুপার গয়নার মতো সিটি গোল্ড ও ইমিটেশনের গয়না। মূল্যায়ন ও পারিশ্রমিক না পাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন। আর করোনার ধাক্কা তাদের সবাইকেই বিপদে ফেলে দিয়েছে।  

এ গ্রামের অলঙ্কার তৈরি কারিগর আলমগীর বাংলানিউজকে বলেন, একটা সময় এতো অর্ডার পেতাম যে আমরা দোকানের করিগররা কাজ করে সারতে না পেরে বাসায়  নিয়ে ঘরের নারীদের দিয়েও কাজ করাতাম। নারীরা বাড়ির কাজের পাশাপাশি আমাদের কাজ করেও সহায়তা করতেন। কিন্তু বর্তমানে বেচা-কেনার অবস্থা এতোটাই খারাপ যে আমরা কারিগররা কাজই পাই না৷ অনেক কারিগর আছেন, যারা পেশা বদল করেছেন।  

আরেক গয়না কারিগর ও ব্যবসায়ী রূপক বাংলানিউজকে জানান, রুপার চেয়ে তামা-পিতলের গয়না বিক্রিতে লাভ বেশি। আমরা গয়না তৈরির কাঁচামাল নিয়ে আসি ভারত থেকে। চায়নার কিছু অলঙ্কার বাংলাদেশে ঢুকে যাওয়ায় আমাদের এ পণ্যের চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে। এমন চলতে থাকলে রুপার মত এক সময় পিতল ও তামার তৈরি গয়নার ব্যবসাও লাটে উঠবে।  

কারিগর লতিফ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কাছে যেমন ইচ্ছা, তেমন ডিজাইনের গয়না তৈরি করা যাবে৷ আমাদের ব্যবসা হয় তিন মাস ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি। এসময় পাইকারদের কাছে প্রতি পিস নেকলেস ৩০০ থেকে হাজার টাকার ভেতর, চুড়ির জোড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকার ভেতর, সীতাহার ৬০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকার ভেতর, নুপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার ভেতর, নাকফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকার ভেতরে বিক্রি করা হয়। এ গহনাগুলো সব পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় অপরিশোধিত অবস্থায়। পরে পাইকাররা কিনে নিয়ে পরিশোধন করে মার্কেটে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি দামে খুচরা বিক্রি করেন।  

স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ও আল-হেরা জুয়েলার্স অ্যান্ড ওয়ার্কশপের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, ভারত থেকে আসা কম দামে 'সিটি গোল্ড' নামে স্বর্ণের রঙের মত তামা-পিতলের গহনার প্রচলন শুরু হয়। সেই থেকেই রুপার গহনার চাহিদা কমতে শুরু করে। পরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায়ী ও কারিগররাও তামা-পিতলের গহনা তৈরি শুরু করেন। ক্রেতাদের পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠ-পোশকতা ও সহযোগিতা পেলে এ শিল্প বেঁচে থাকবে, তা না হলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।  

 

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।