ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঘোড়া আর মহিষের গাড়িই চরবাসীর ভরসা!  (ভিডিওসহ)

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০২০
ঘোড়া আর মহিষের গাড়িই চরবাসীর ভরসা!  (ভিডিওসহ)

লালমনিরহাট: বর্ষাকালে প্রবল স্রোতে নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়া ও মহিষের গাড়ি ছাড়া লালমনিরহাটের চরাঞ্চলের মানুষের পণ্য পরিবহনের আর কোনো বাহন নেই। ফলে এ গাড়ির চাহিদা এখানে অনেক।

চাহিদা বেশি থাকায় চরাঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে এসব বাহনের সংখ্যা।

জানা গেছে, তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটে রয়েছে প্রায় অর্ধশত চর এলাকা। বর্ষাকালে বন্যা আর নদী ভাঙনের মত প্রকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় এ চরাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবারকে। বর্ষাকালে নদীর স্রোতে বিলীন হয় ঘরবাড়ি ও মাঠের পর মাঠ ফসলি জমি। উজানের পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বাড়ে। বন্যায় প্লাবিত হলে চরই হয়ে ওঠে নৌপথ। তখন নৌকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করেন চরবাসী। তখন কদর বাড়ে নৌকার। তবে বর্ষা শেষ হলেই নৌকা পড়ে থাকে ধু ধু বালুচরে।  

বর্ষার শেষে শীত না আসতেই শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় তিস্তা ও ধরলা নদী। নদীর মধ্যে জেগে ওঠে অসংখ্য চর। মাঠের পর মাঠ ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়। তখন নৌকা অকেজো হয়ে পড়ে। এসব বালুচরেও নানা জাতের ফসল চাষাবাদ করেন তারা। দীর্ঘ শুকনো মৌসুমে চরাঞ্চলের মানুষদের মাইলের পর মাইল ধু ধু বালুময় পথ মাড়িয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় তাদের। এ শুষ্ক মৌসুমে তাদের পণ্য পরিবহনে ঘোড়া ও মহিষের গাড়ি ছাড়া আর কোনো বাহন থাকে না। শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা বাড়ায় এসব গাড়ির কদর বাড়ছে চরাঞ্চলে।  

লালমনিরহাটের মূল ভূখণ্ড থেকে কোনো কোনো চরাঞ্চলের দূরুত্ব ৫-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত। এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাট-বাজারসহ অফিস-আদালতে যেতে হয় চরবাসীদের। চরাঞ্চলেও গড়ে উঠেছে ছোট ছোট দোকান ও বাজার। সেখানকার ব্যবসায়ীরা মূল ভূখণ্ড থেকে মালপত্র কিনে ঘোড়া বা মহিষের গাড়িতে করে চরে আনেন। এর জন্য এক কিলোমিটারে প্রতিমণ পণ পরিবহনে গুণতে হয় ২৫-৩০ টাকা। একইভাবে চরাঞ্চলের চাষিদের উৎপাদিত ফসল বাজারে বা মূল ভূখণ্ডে নিতে হয় ঘোড়া আর মহিষের গাড়িতেই।

ঘোড়া ও মহিষের গাড়িয়ালরা জানান, মাইক্রোবাসের চাকা লাগিয়ে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ঘোড়ায় গাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে ১২-১৫ হাজার টাকা এবং বয়স ও স্বাস্থ্যভেদে একেকটি ঘোড়ার দাম পড়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা। মহিষের গাড়ি তৈরিতেও একই রকম খরচ হয়। কিন্তু এক জোড়া ভালো শক্তিশালী মহিষ কিনতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। এসব গাড়িতে পণ্য পরিবহন করে দৈনিক ঘোড়ার গাড়িতে ৪শ’-৫শ’ এবং মহিষের গাড়িতে ৭শ’-৮শ’ টাকা আয় করেন গাড়িয়ালরা। সময় ভেদে আয়ও বেড়ে যায়। তবে ঘোড়া আর মহিষের খাবার খরচ পড়ে দৈনিক একশ’-দেড়শ’ টাকা।  

চরাঞ্চলের বালুময় ও হাঁটু পানির পথে ঘোড়া বা মহিষের গাড়ি ছাড়া অন্য বাহন চালানো অসম্ভব। তাই চরাঞ্চলে এর চাহিদা ব্যাপক। গাড়ি চালিয়েও অনেকের সংসার চলে। গাড়ি চালাতে গিয়ে অনেকের নামও পরিবর্তন হয়েছে। আবু কালামকে ঘোড়া কালাম এবং মহিষের গাড়িচালক সাহাবুদ্দিনকে সাবুদ্দি গাড়িয়াল নামেই ডাকা হয়। বাড়িতে এসব গাড়ি থাকায় শিশুরাও মনের অজান্তে দক্ষ গাড়িচালক বনে যাচ্ছে।  

শৈলমারী কালিকাপুর চরের আট বছরের শিশু তানজিরুল বাবার গাড়ি চালিয়ে দক্ষ চালক বনে গেছে। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে পরিবারের সদস্যদের জন্য চাল-ডালের পাশাপাশি ঘোড়া ও মহিষের জন্য খড়, ভুষি, ধানের কুড়া, ভুট্টার কুড়া, খৈল কিনে নিয়ে যান গাড়িয়ালরা।  

কালীগঞ্জের শৈলমারী চরের ঘোড়ার গাড়িচালক জসির উদ্দিন, খোরশেদ ও মমিন জানান, কখনো বালু আবার কখনো হাঁটু পানির পথে পণ্য পরিবহনে ঘোড়া বা মহিষের গাড়ির বিকল্প নেই। কিলোমিটারে মণপ্রতি ২৫-৩০ টাকা ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করেন। দিন শেষে ৪শ’-৫শ’ টাকা আয় হয় তাদের। শুষ্ক মৌসুমে কদর বেশি থাকলেও বর্ষার তিন মাস কর্মহীন থাকতে হয় তাদের।  

একই চরাঞ্চলের মহিষের গাড়িচালক একরামুল হক বাংলানিউজকে বলেন, মহিষের একটা গাড়ি তৈরিতে দেড়-দুই লাখ টাকা খরচ হয়। ঘোড়ার চেয়ে মহিষে খরচ যেমন বেশি। তেমনি ঘোড়ার চেয়ে বেশি ওজন পরিবহন করতে পারে মহিষ। তাই আয়ও বেশি। আট-১০ বছর ধরে গাড়ি চালিয়ে চলছে তার সংসার।

আদিতমারীর গোবর্ধন চরাঞ্চলের আবু কালাম ওরফে ঘোড়া কালাম বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ ২৫-৩০ বছর ধরে চরাঞ্চলের মানুষের পণ্য পরিবহন করছি ঘোড়ার গাড়িতে। এ কারণে মানুষ আমাকে ঘোড়া কালাম নামেই চেনেন। শুধু পণ্যই নয়, ঘোড়ার গাড়িতেই অনেক রোগীকেও হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি।  

কালীগঞ্জের ভুল্লারহাটের পাইকারী ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, চরাঞ্চলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা শহর থেকে পণ্য কিনে ঘোড়া বা মহিষের গাড়িতে করে চরাঞ্চলে নিয়ে খুচরা বিক্রি করেন। পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে চরাঞ্চলে পণ্যের দামও কিছুটা বেশি। একই সঙ্গে চরাঞ্চলে উৎপাদিত ফসল বাজারে এনে বিক্রি করেও খুব একটা লাভবান হতে পারেন না চাষিরা। তাদের পরিবহন খরচ বেড়ে যায়।  

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বর্ষাকালে নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়া বা মহিষের গাড়িই চরাঞ্চলের মানুষের বাহন। পণ্য পরিবহন বা যাতায়াতে এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই তাদের। পাশাপাশি রোগী পরিবহনেও এসব গাড়ি ব্যবহার করেন চরাঞ্চলের মানুষ। বর্ষাকালে জরুরি প্রয়োজনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি নৌকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

 

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।