বরিশাল: জয় বাংলার স্লোগানে বরিশালের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর। সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল বরিশাল ও ঝালকাঠি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন পুলিশ সুপার ফখরুল ইসলামের কাছ থেকে চাবি নিয়ে বরিশাল পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার ভেঙে গুলি, রাইফেল নিয়ে যায়।
২৬ মার্চ মেজর এম এ জলিলকে উজিরপুরের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়। সকালে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে পরিস্থিতি মোকাবিলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জুকে বেসামরিক প্রধান ও মেজর এম এ জলিলকে সামরিক প্রধান করে বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণাঞ্চলীয় স্বাধীন বাংলা সরকারের সচিবালয়। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অন্তর্ভুক্তি ও ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হত।
১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদাররা আকাশ পথে বরিশালে প্রথমে হামলা চালায়। পরে ২৫ এপ্রিল জল, স্থল ও আকাশ পথে দ্বিতীয় দফা আক্রমণ হয়। হানাদার বাহিনী স্থল পথে বরিশাল আসার পথে গৌরনদীতে ও নৌপথে গানবোট যোগে প্রবেশের চেষ্টাকালে শহরতলী তালতলীর জুনাহারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। কিন্তু উভয় স্থানে ভারী অস্ত্রের সামনে পিছু হটতে বাধ্য হয় মুক্তিযোদ্ধারা। আর হানাদার বাহিনী চালায় হত্যাযজ্ঞ।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথমে অশ্বিনী কুমার হলে অবস্থানের পর জিলা স্কুলে এবং সর্বশেষ ওয়াপদায় (বর্তমান আঞ্চলিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের কম্পাউন্ড) তাদের হেড কোয়ার্টার গড়ে তোলে। এখানে বাংকার খুঁড়ে ভারী অস্ত্রের সমাবেশ ঘটায় তারা। এখানেই তৈরি করা হয় নির্যাতন কক্ষ। ৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ক্যাপ্টেন শাহজাহানকে বরিশাল সাব সেক্টরের দায়িত্ব দিয়ে বরিশাল পাঠান। এ সময় তার নতুন নামকরণ করা হয় ক্যাপ্টেন ওমর। নভেম্বর মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধারা থানাগুলোতে আক্রমণ চালাতে শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ বরিশালে কারফিউ ঘোষণায় মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবে সড়ক পথ চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় পাকিস্তানি হানাদাররা পালানোর পথ হিসেবে জল পথকে বেছে নেয়। ৮ ডিসেম্বর ভোর রাতের মধ্যে তারা বরিশাল ছাড়ে। সে পথেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোষররা নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় মুলাদীর কদমতলা নদীতে লঞ্চ, চাঁদপুরের মেঘনা মোহনায় কিউ জাহাজসহ গানবোট ও কার্গো ধ্বংস হয়েছিল।
৮ ডিসেম্বর প্রথমে সুলতান মাস্টার মুক্ত বরিশাল শহরে ঢুকে কোতোয়ালি থানা দখল করেন। এভাবে একে একে বরিশাল শহরের বিভিন্ন স্থাপনা দখলে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। এর পর উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পলায়নে জয় বাংলা ধ্বনিতে হাজার হাজার জনতা রাজপথে নেমে পড়ার মধ্য দিয়ে বরিশাল মুক্ত হলেও বরিশালের গৌরনদী পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয় ২২ ডিসেম্বর।
অপরদিকে বরিশালের পার্শ্ববর্তী জেলা ঝালকাঠিও হানাদার মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ এর এদিনে বিজয়ের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢুকে। জেলার সর্বত্র আনন্দ উল্লাসে স্বাধীনতাকামী জনতা। ১৯৭১-এর ২৭ এপ্রিল ভারী কামান আর মর্টার শেলের গোলা নিক্ষেপ করতে করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝালকাঠি শহর দখলে নেয়। এরপর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকাদের সহায়তায় ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলাজুড়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুট আর অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় নির্যাতন চালায়। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন নিরীহ বাঙালিদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে পৌরসভা খেয়াঘাট এলাকায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ৭ ডিসেম্বর শহরে কারফিউ জারি করে রাতের আঁধারে ঝালকাঠি ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরের দিন ৮ ডিসেম্বর রাজাকাররা তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত জয় বাংলার স্লোগানে মুখরিত হয় ঝালকাঠির আকাশ বাতাস। একই দিন পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয় ঝালকাঠির বর্তমান নলছিটি উপজেলা।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২০
এমএস/আরবি