ঢাকা: ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর মাগুরার শ্রীপুর থানা এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে মৃতের পরিচয় না পেয়ে অজ্ঞাত হিসেবেই ওই ব্যক্তিকে দাফন করা হয়।
এদিকে, কুষ্টিয়ার কুমারখালি এলাকায় শহিদুল ইসলাম (৪৭) নামে এক গরু ব্যবসায়ী নিখোঁজ হন ২৩ ডিসেম্বর। এ ঘটনায় শহিদুলের মা তমিরুন নেসা বাদী হয়ে কুষ্টিয়ার আদালতে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০১৯ সালের নভেম্বরে মামলাটির তদন্তভার পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আর ওই অপহরণ মামলার তদন্তে উদঘাটিত হয় শহিদুলকে খুনের রহস্য। সিআইডি নিশ্চিত হয় মাগুরার শ্রীপুরে অজ্ঞাত মরদেহ হিসেবে উদ্ধার ব্যক্তিই শহিদুল। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় রোজিনা বেগমকে। তিনি নিজের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মালীবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম।
সিআইডি জানায়, শহিদুলের মা তমিরুন নেসা বাদী হয়ে কুষ্টিয়ার আদালতে দায়েরকৃত অপহরণ মামলায় শহিদুলের মৃত শ্যালক মোতাহারের স্ত্রী রোজিনা, তার বাবা জব্বার শেখ ও মা মতিরন নেসাকে আসামি করা হয়। এরপর আদালত মামলাটি থানাকে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। থানা পুলিশের পর পুলিশ সদর দফতর ২০১৯ সালের নভেম্বরে অপহরণ মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
শেখ নাজমুল আলম বলেন, অপহরণ মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ২২ নভেম্বর রোজিনা বেগমকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীকালে রোজিনা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাবন্দি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, শহিদুলের শ্যালক মোতাহারের সঙ্গে রোজিনা বেগমের বিয়ে হয়। মোতাহের ভালো ঘর না থাকায় বউ নিয়ে দুলাভাই শহিদুলের বাড়িতেই থাকতেন। এসময় শ্যালকের বউয়ের প্রেমে পড়েন শহিদুল। বিষয়টি জানাজানি হলে, মোতাহার তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাড়ি করে সেখানে থাকা শুরু করেন।
তবে এর কয়েক বছর পর মোতাহার মারা যান। এর মধ্যে শহিদুলের স্ত্রীও মারা যান। তখন শহিদুল শ্যালকের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়মিত করার চেষ্টা করেন। তাকে বিয়ে করতে চান। তবে সম্পর্ক থাকলেও রোজিনা শহিদুলকে বিয়ে করতে রাজি হননি। এদিকে, গ্রামে এ সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। পরবর্তীকালে রোজিনা বাবার বাড়িতে চলে গেলেও শহিদুলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।
রোজিনা, মোমিন, শহিদুল
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুজিৎ কুমার ঘোষ জানান, কয়েকমাস পর রোজিনা ঢাকার মানিকগঞ্জে গিয়ে আকিজ গ্রুপে চাকরি নেন। সেখানে মোমিন নামে একজনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। মোমিনের গ্রামের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুরে। এক পর্যায়ে তাকে বিয়ে করেন রোজিনা। তবে এরপরও শহিদুলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো। পরবর্তীতে মোমিন ও রোজিনা পরিকল্পনা করেন শহিদুলকে হত্যা করার।
এক পর্যায়ে মোমিন ও রোজিনা মাগুরার শ্রীপুরে চলে যান। রোজিনা শহিদুলকে ফোন দিয়ে জানান, তিনি তাকে বিয়ে করবেন। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে বিয়ের কথা বলে তাকে শ্রীপুর নিয়ে যান।
শ্রীপুরের লাঙ্গলবাদ বাজার থেকে এক কেজি মিষ্টি কেনেন শহিদুল। ওই বাজারে আগে থেকেই শহিদুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন রোজিনা ও মোমিন। তারা দু’জন শহিদুলকে একটি খোলা মাঠ থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যান।
দূরের আলো দেখিয়ে রোজিনা শহিদুলকে বলেন, ওই বাতি জ্বলা বাড়িটি আমার বান্ধবীর, সেখানে যাবো। মাঠের কিছুদূর যাবার পর রোজিনা ও মোমিন মিলে শহিদুলকে ঝাপটে ধরেন। প্রায় আধঘণ্টা তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এরপর শহিদুল ক্লান্ত হয়ে গেলে রোজিনা তার বুকের ওপর উঠে বসে দুই হাত চেপে ধরেন। মোমিন চাকু দিয়ে শহিদুলের গলায় একাধিক বার ছুরিকাঘাত করেন। তবে চাকুতে ধার না থাকায় প্রথমে শহিদুলের গলা কাটেনি। পরে চাকুর সরু মাথা দিয়ে মোমিনকে আঘাত করতে থাকেন। এরপর শহিদুল নিস্তেজ হয় যায়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার হাত পায়ের রগ কেটে দেন মোমিন। পরবর্তীতে সেখানে মরদেহ রেখে তারা মোমিনের বাড়িতে যান।
পরের দিন শ্রীপুর থানা পুলিশ পরের দিন অজ্ঞাত হিসেবে শহিদুলের মরদেহ উদ্ধার করে। ধারণা করা হয়েছিল, চরমপন্থিরা তাকে হত্যা করেছে। একটি হত্যা মামলা হলেও থানা পুলিশ তদন্তে কোনো কূল-কিনারা করতে না পারায় হত্যা মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেন। মরদেহ অজ্ঞাত হিসেবেই থাকে, কারণ ওই এলাকায় শহিদুলকে কেউ চিনতে পারেনি।
সুজিৎ ঘোষ বলেন, আমি অপহরণ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে প্রথমে শহিদুলের সর্বশেষ অবস্থান কোথায় ছিল তা শনাক্তের চেষ্টা করি। তার ব্যবহৃত মোবাইলটির সর্বশেষ অবস্থান ছিল মাগুরার শ্রীপুরের লাঙলবাদ বাজারে। রোজিনার ব্যবহৃত সিমটিও একই এলাকাতে ছিল। এরপর আমরা রোজিনাকে ঢাকার আশুলিয়া থেকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। পরবর্তীকালে তিনি সব স্বীকার করেন। এরপর মোমিনকেও গ্রেফতার করা হয়, তিনিও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
রোজিনার দেওয়া স্বীকারোক্তির পর সিআইডি মাগুরার শ্রীপুর থানায় খোঁজ নিয়ে জানাতে পারে, ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঠিকই রোজিনার বক্তব্য অনুযায়ী ওই এলাকা থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যাকে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
অপহরণ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে জানা গেছে শহিদুলকে হত্যা করা হয়েছে। তাই হত্যা মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করা হবে বলেও জানান ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২০
পিএম/এফএম