ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পুলিশ পরিবারে সম্পদের পাহাড়, দুদকে মামলা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০২১
পুলিশ পরিবারে সম্পদের পাহাড়, দুদকে মামলা

লালমনিরহাট: একই পরিবারে ৪ পুলিশের নামে বে-নামে সম্পদের পাহাড়। অবৈধ সম্পদের আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন আইনে মামলা দায়ের করেছেন তারিকুজ্জামান তুহিন নামে এক ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান তুহিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স তুহিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী।  

অভিযুক্তরা হলেন, রংপুরের মাহিগঞ্জ পুর্বখাসবাগ এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য নুর ইসলাম ও তার ছেলে ঢাকা এপিবিএনের উপ পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান সুমন (পুলিশ আইডি নম্বর- ৮৬১৩১৪৭৯৮৮), শিল্পাঞ্চলের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রোকনুজ্জামান (পুলিশ নম্বর-৮৭০৬০৯৯৪৯), কুড়িগ্রাম আদালত পুলিশের সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) মফিকুজ্জামান (পুলিশ নম্বর- ৮৩০৩০৮৩১৭৮), হাসানুজ্জামান ও পুত্রবধূ কাজলি বেগম।  

মামলার বিবরণে জানা যায়, নিজেকে ঢাকার এপিবিএনের এসআই পরিচয় দিয়ে মনিরুজ্জামান সুমন বুড়িমারী স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান তুহিনের কাছ থেকে বাকিতে ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৪৫৫ টাকার পাথর কেনেন। সেই টাকা চাওয়ায় মোবাইলে হুমকি দেন এবং স্ত্রী ও বোনকে দিয়ে একাধিক মিথ্যা নারী নির্যাতন ও মিছ পিটিশন মামলা করেন ওই পুলিশ অফিসার। যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এভাবে পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন পুলিশ অফিসার মনিরুজ্জামান।

মামলার বিবরণ মতে, ২০০৩ সালে পুলিশে অবসর নেওয়া নুর ইসলাম রংপুর সাতমাতা পুর্বখাসবাগে ১২ শতাংশ জমির উপর ১০ তলা ভিত্তির বাড়ি নির্মাণ করেন। তার ছেলে এপিবিএনের এসআই মনিরুজ্জামান ২০১৪ সালে পুলিশে যোগ দিয়ে ৬ বছরেই ঢাকার বাড্ডায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমির স্বপ্নকুটিরের ১১ তলা ফ্ল্যাটের ৪০ লাখ টাকার শেয়ার মালিক। রাজধানীর সবুজবাগে এসআই মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রী কাজলির নামে ৯৬ লাখ টাকার ৮ শতাংশ জমির উপর ১০ তলার গ্রিন প্লাজা নির্মাণাধীন রয়েছে। এসআই মনিরুজ্জামান এবং তার ভাই এএসআই রোকনুজ্জান,  হাসানুজ্জামান ও দুইজন পার্টনারসহ যৌথ নামে ঢাকার দক্ষিণ কাজি বাড়ি মোড়ে ৫ কাঠা জমির উপর ড্রিমওয়ে টাওয়ার নামে ১০ তলা ভবন নির্মাণ চলমান রয়েছে। আফতাব নগরে দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৫ কাঠা জমির গ্রিন সুরভী কনস্ট্রাকশনের ব্যবসার অর্ধেক শেয়ারের মালিক এসআই মনিরুজ্জামান। ৩ বছরে ছেলে আল ওয়াফির নামানুসারে আল ওয়াফি প্রোপার্টিজ লিমিটেড নামে গড়েছেন রিয়েল স্টেট ব্যবসা।

ঢাকা খিলগাঁও ত্রিমোহনী এলাকায় আড়াই কাঠা, বনশ্রী লিংক রোডে ৩ কাঠা জমি এবং আফতাব নগরের মেরুল বাড্ডায় ১২ কাঠা জমির উপর ১৪ তলা ড্রিম ভ্যালির ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন এসআই মনিরুজ্জামান সুমন। এছাড়াও বনশ্রী টেকেরপাড় চৌরাস্তা মোড়ে ৩ কাঠায় ৭ তলা, একই এলাকার জে ব্লোকে ১০ কাঠা, পাশে ৩ কাঠা ও আফতাব নগর আবাসিক এলাকার সাড়ে ৫ কাঠা জমিতে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। বনশ্রী ব্লোক জে'তে গ্রিন প্লাজা ও আফতাবনগরের এল ব্লোকে ড্রিমটাচ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু করেছেন তিনি। এসআই মনিরুজ্জামান ২০১৬ সালে রংপুরের পীরগাছার কাজলি বেগমকে বিয়ে করে অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে স্ত্রীর নামে হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন।

এএসআই রোকনুজ্জামান ২০০৭ সালে পুলিশে যোগ দিয়ে ১৭ সালে পদোন্নতি নিয়ে তিনিও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। তিনিও ঢাকার জিয়া স্মরণী রোড়ে ৯০ লাখ টাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছেন। বাড্ডা রোড়ে কফি এক্সপ্রেস নামের ৪৫ লাখ টাকার দোকানটিও এএসআই রোকনুজ্জামানের নামে। একই সঙ্গে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রী ফাউন্ডেশন ড্রিম ক্যাসটেল প্রজেক্টের এল  ব্লোকে ৮৬ লাখ টাকায় ডাবল ফ্ল্যাট কেনন তিনি। তার নামেই রয়েছে দুইটি পাসপোর্ট। প্রায় সময় বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত কাজে ভ্রমণ করেন তিনি।  

এএসআই মফিকুজ্জামান ভাইদের পুলিশী ক্ষমতায় ভয়ভীতি দেখিয়ে ৭৪ লাখ টাকা মূল্যে রংপুরের কামালকাছনায় ১৪ শতাংশ জমিসহ আধাপাকা বাড়ি কিনেছেন। অপর ভাই হাসানুজ্জামান চট্টগ্রামে জাহাজে চাকরি করলেও নিজেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে পুলিশ অফিসার ভাইদের প্রভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।  

এছাড়াও এই পুলিশ পরিবার তাদের আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে ইটভাটা, চালের আড়ত, মুদির দোকান এবং নিজ এলাকায় ও ভাইদের শ্বশুর বাড়িতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি। পুলিশে চাকরির প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পথে অর্থ আদায় করে ২০১৪ সালে হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয় পরিবারটি। তাদের এসব অবৈধ সম্পদের তদন্ত পূর্বক দুদক ও মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নিতে তাদের ৬ জনের বিরুদ্ধে ১২ ডিসেম্বর রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে মামলা দায়ে করেন ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান তুহিন।  

অভিযুক্ত এসআই মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, আমার স্ত্রী তার বান্ধবীর সঙ্গে যৌথ ব্যবসা করে সম্পদ করেছেন। স্ত্রীর ব্যবসায় তো বাঁধা নেই। আমার মাত্র একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পুলিশের অনেকেই অনেক কিছু করেছেন। পাথরের কিছু টাকা বকেয়া থাকায় ব্যবসায়ী তুহিন মামলা করেছেন। আইনীভাবে মোকাবিলা করা হবে।  

কুড়িগ্রাম আদালত পুলিশের এএসআই মফিকুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব থাকলে ভাইয়ের সঙ্গে ছিল। সেই বিরোধে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ বিভাগে আমাকে হেয় করার কোনো কারণ বুঝিনি। আমিও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করবো। তবে তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।  

রংপুর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট অর্পিতা বসু রায় বাংলানিউজকে বলেন, আসামিরা পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন। তাই দুদক ও মানি লন্ডারিং আইনে বাদির দায়ের করা অভিযোগটি আমলে নিয়ে দুদককে তদন্তে দিয়েছেন আদালত। আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।