ঢাকা: রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বুড়িরটেকে (আলীনগর) সাহিনুদ্দিন ও তার স্বজনদের ১০ একর জমি রয়েছে। মূলত ওই জমি দখল করতেই লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালের নির্দেশেই সাহিনুদ্দিনকে তার সন্তানের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে এ হত্যার ঘটনায় আরও ৫ থেকে ৬ জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের একাধিক টিম রাজধানীসহ সম্ভাব্য বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পল্লবীতে সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিনকে হত্যার নির্দেশদাতা সাবেক এমপি আউয়ালসহ প্রত্যক্ষ্যভাবে অংশ নেওয়া মোট ১১ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার অভিযানে সরাসরি জড়িত থাকা দুই আসামি মনির ও মানিক র্যাব ও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এ মামলায় আরও ৫ থেকে ৬ আসামি পলাতন রয়েছেন। পলাতক থাকা আসামিদের গ্রেফতারের তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে।
এছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম পলাতক আসামিদের গ্রেফতার অভিযান চলমান রয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করা গেলে এই হত্যাকাণ্ডে তাদের কার কি ভূমিকা ছিলো সেগুলো জানা যাবে। এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) খুব দ্রুতই আদালতে জমা দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. আহসান খান বাংলানিউজকে বলেন, সাহিনুদ্দিন হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সব আসামি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা সাবেক এমপি আউয়ালকে আদালতে নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় আরও ৫ থেকে ৬ আসামি পলাতক রয়েছেন, তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে গত ১৬ মে পল্লবীতে আধিপত্য বিস্তার ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সন্তানের সামনেই সাহিনুদ্দিন (৩৪) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওইদিন বিকেলে সাত বছর বয়সী শিশু সন্তান মাশরাফিকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরছিলেন সাহিনুদ্দিন। এমন সময় একজনের ফোনকল পেয়ে পল্লবীর ৩১ নম্বর রোডে দেখা করতে যায়। সেখানে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা শিশু মাশরাফিকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে তার বাবা সাহিনুদ্দিনকে ৬-৭ জন এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন। ৫/৬ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সাহিনুদ্দিনের শরীরের মাথা, গলাসহ উপরের অংশ ধারালো অস্ত্রের কোপের অসংখ্য জখম পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় নিহত সাহিনুলের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে নামধারী ২০ জনকে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১৪/১৫ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে এর তদন্ত ভার দেওয়া হয় গোয়েন্দা (ডিবি) মিরপুর বিভাগকে।
নিহত সাহিনুদ্দিন রাজধানীর পল্লবীর উত্তর কালশীর সিরামিক এলাকায় বসবাস করতেন। তার পরিবারে আকলিমা বেগম ও দুই ভাই (সাহিনুদ্দিন ও বড় ছেলে মাঈনুদ্দীন) স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করতেন। ২০২০ সালে সাহিনুদ্দিনের বাবার মৃত্যুর পর থেকেই বাউনিয়া মৌজার উত্তর কালশীর বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকায় তাদের ১০ একর জমি দখলের পাঁয়তারা করে আসছিলেন করতেই আউয়াল।
কলাবাগানে বসেই হত্যার পরিকল্পনা ফাইনাল:
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০০৪ সাল থেকে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বুড়িরটেকে (আলীনগর) সাহিনুদ্দিন ও তার স্বজনদের মালিকানা ১০ একর জমি দখলের পাঁয়তারা করছিলেন সাবেক এমপি আউয়াল। কারণ সাহিনুদ্দিনদের জমির পাশেই বেশ কিছু জমি অবৈধ দখন করে নেয় হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামে আবাসন প্রকল্প, তা প্রতিষ্ঠা করেন আউয়াল। ২০২০ সালের জুলাইতে সাহিনুদ্দিনের বাবার মৃত্যুর পর থেকে এই দখলের চাপ বেড়ে যায়। এ বিষয়ে পল্লবী থাকা একটি মামলাও করেছিল সাহিনুদ্দিনের পরিবার। হত্যাকাণ্ডের এক মাস আগে জমি দখলের বিরোধে পল্লবী এলাকার মাদককারবারি ও সন্ত্রাসী সুমনের সঙ্গে সাহিনুদ্দিনের মারামারি হয়। এ ঘটনায় পুলিশ সাহিনুদ্দিনকে গ্রেফতার করেছিলো। ঘটনার ১ সপ্তাহ আগে সাহিনুদ্দিন জামিনে মুক্তি পান। এরপরই তাকে হত্যার পরিকল্পনায় মগ্ন হয়ে পড়েন আউয়াল।
হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার সাবেক এমপি আউয়াল, হাসান ও বাবু পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, হত্যাকাণ্ডের ৪/৫ দিন আগে সাবেক এমপি আউয়ালের কলাবাগান অফিসে বসে সাহিনুদ্দিনকে হত্যার পরিকল্পনা সংঘটিত হয়। সেখানে আউয়ালের ম্যানেজার তাহের এবং পল্লবী এলাকার মাদককারবারি সুমনও উপস্থিত ছিলো। পরিকল্পনার পর সুমনের সঙ্গে আউয়ালের ম্যানেজার ৩০ লাখ টাকার চুক্তিও করেছিলো। কিছু টাকা সুমনকে অগ্রিম দেওয়া হয়। আর বাকি টাকা টিটুর (মামলার ৮ নম্বর আসামি) মাধ্যমে দেওয়ার কথা ছিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করতে সুমন, মনির, হাসান, মানিক, ইকবাল, মুরাদ, রকিসহ ১০/১২ জন অংশ নেয়। তারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।
গ্রেফতার আসামিদের স্বীকারোক্তি:
সাহিনুদ্দিন হত্যার ঘটনায় গত ১৯ মে রাত সাড়ে ১১টায় চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে জড়িত হাসানকে গ্রেফতার করে র্যাব। ২০ মে বাউফল পটুয়াখালী থেকে জহিরুল ইসলাম বাবুকে গ্রেফতার করা হয়। মামলার অন্যতম আসামি সুমন বেপারীকে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকা থেকে এবং তার দেওয়া তথ্যে পল্লবী থানার কালাপানি এলাকা থেকে রকি তালুকদারকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর ২১ মে দিনগত রাতে পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় র্যাব-৪ এর সদস্যদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানিক নিহত হন। সাহিনুদ্দিন হত্যার অন্যতম আসামি নিহত মানিক। অব্যাহত অভিযানে ২১ মে ভোরে ভৈরবে অভিযান চালিয়ে হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী আউয়ালকে গ্রেফতার করে র্যাব। একই দিনে চাঁদপুর ও পটুয়াখালীতে পৃথক অভিযান চালিয়ে হাসান ও জহিরুল ইসলাম বাবু নামে আরও দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২২ মে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘কিলার’ শরিফকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সাহিনুদ্দিন হত্যায় ভাড়াটে কিলার হিসেবে শরিফ সরাসরি অংশ নিয়েছিলো। ২৩ মে ভোরে পল্লবী সাগুফতা হাউজিং এলাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের সরাসরি জড়িত থাকা আসামি মনির নিহত হয়। সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি মনির। পরে ২৬ মে রাতে পল্লবীর সিরামিক এলাকা থেকে বাবু ওরফে কালা বাবু ওরফে কালু ওরফে শেখ রাসেল হোসেনকে (২৬), গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারের পর আসামিরা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ মে সুমন, বাবুসহ কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন বৈঠক করেন। ১৬ মে বিকেলে ঘটনাস্থলে তারা জড়ো হয়। তারপর ভুক্তভোগী সাহিনুদ্দিন সন্তানসহ ঘটনাস্থলে আসলে সুমন, মনির, মানিক, হাসান, ইকবাল ও মুরাদসহ ১০-১২ জন এলোপাথারিভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পর্যায়ক্রমে কোপাতে থাকে। এতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া আসামি মনির সাহিনুদ্দিনের শরীরের উপরের অংশে এবং হাঁটুতে আর মানিক হাত-পায়ে কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
আউয়াল একজন আবাসন ও জমি ব্যবসায়ী। তার ছত্রছায়াতে সুমন সন্ত্রাসী গ্রুপ দিয়ে জমিদখল ও আধিপত্য বিস্তার করতেন। এজন্য আওয়ালের কাছ থেকে তারা মাসিক ১০-১২ হাজার টাকা পেতেন। ক্ষেত্র বিশেষ কাজ অনুয়ায়ী অতিরিক্ত টাকা দিতেন আওয়াল। এই সন্ত্রাসী দল সুমন এলাকায় চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতেন বলেও তারা স্বীকার করেছেন। রাজধানীর পল্লবী এলাকার যুবক সাহিনুদ্দিন খান (৩৩) হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সুমন।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ:
নিহত সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, আমাদের এই জমি দখলের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালান সাবেক এমপি আউয়াল। আমার দুই ছেলেকে হত্যার হুমকিও দেয়। কিন্তু নিতে পারেনি। এই জমি দখলের জন্য গত বছরের নভেম্বরের দিকেও সন্ত্রাসীরা সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে আহত করেছিল। সেই ঘটনায় থানায় একটি মামলা করা হয়েছিল। তবে পুলিশ সন্ত্রাসীদের কাউকে গ্রেফতার করেনি। উল্টো আউয়ালের দেওয়া মিথ্যা মামলায় সাহিনুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনার এক সপ্তাহ আগে সাহিনুদ্দিন জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু জমি লোভী আউয়াল আমাদের এই জমি দখল করে নেওয়ার জন্যই ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। আমার ছেলের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২১
এসজেএ/এএটি