ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মাগুরছড়া ট্রাজেডি: ২ কোম্পানির হাত বদল করে ঠেকেছে তৃতীয়তে

 বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১২ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২১
মাগুরছড়া ট্রাজেডি: ২ কোম্পানির হাত বদল করে ঠেকেছে তৃতীয়তে

মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারের ভয়াল স্মৃতির দিন ‘মাগুরছড়া ট্রাজেডি’র ২৪তম বার্ষিকী আজ। ১৪ জুন এলেই মৌলভীবাজারবাসীর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে বনের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের লেলিয়ান শিখা।

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাত ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া এলাকা।

প্রায় ৫শ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল রাতের আকাশ। ভয় পেয়ে স্থানীয় লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে ছুটেছিলেন এদিক-সেদিক।

এ আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল  উপজেলার একমাত্র সড়কটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। দীর্ঘ দুই যুগ কেটে গেলেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা এবং গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ।

পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্যমতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ হয়। সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। ফিরে আসেনি এখনো প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সবশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি করেছে। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

২০১২ সালে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নম্বর ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ী এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজবেষ্টনী কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর চলছে। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ২৪ বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি করা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে।

বর্তমানে মূল কূপটি এখন পুকুরের মতো রূপ ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে, ক্ষতিপূরণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে পরিবেশবাদীসহ স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন। দাবি আদায়ে মানববন্ধন, পদযাত্রা, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণসংযোগসহ নানা কর্মসূচির পালন করে যাচ্ছে।

স্থানীয় ভিলেজার হাতিম আলী বলেন, সেই দিনটির কথা মনে হলেই অবাক হই! আগুনের লেলিহান শিখা পুরো আকাশকে লাল করে বহু বহু উপরে উঠে যায়। যা দেখে ভয়ে আমাদের অনেকেই গ্রাম ছেড়েছিলেন।  

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আজ পর্যন্ত একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ পাইনি আমরা। মানে সরকার পায়নি। বনেরও একটা ক্লেইম (অভিযোগ) ছিল। অক্সিডেল্টালের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। ওরা দেখেন, কায়দাকানুন করে দায়িত্বভার আরেক তেলগ্যাস কোম্পানি ইউনিকলকে দিয়ে সটকে গেল। ইউনিকলও আবার হাত বদল করে অপর তেলগ্যাস কোম্পানি শেভরনকে দিয়ে গেল। তাহলে এখন আপনি কাকে ধরবেন? এগুলো ইউএসএ কোম্পানি। এদের কার্যপরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার পুরোপরি অভাব রয়েছে। আর আমাদের দেশকে যেন কিছুই মনে করে না ওরা। আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ওরা চলে গেছে।

তারপরও ক্লেইম (অভিযোগ) করা আছে। ক্লেইম কিন্তু হস্তান্তর হলেও এখন সেটি শেভরনের উপর দায়িত্ব আছে। শেভরন কিন্তু দায়-দায়িত্ব নিয়েছে ওগুলোসহই। কারণ, দায়দায়িত্ব নিশ্চয়ই ওরা পরের কোম্পানিকে দিয়ে যাওয়ার কথা। আবার নাও করতে পারে। কারণ অক্সিডেন্টালের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। যতদূর মনে পড়ে, পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্লেইম করা হয়েছিল। এর মধ্যে বন ও পরিবেশের ক্ষতি ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। মোট কথা, আমরা কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ পাইনি বলে জানান ডিএফও রেজাউল করিম চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২১
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।