বরিশাল: ‘এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার নৌযানে কার্যকরী অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার পাশাপাশি ইঞ্চিন রুমের সেফটির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। যদিও ছোট ও বড় আকারের লঞ্চগুলোতে কতটা নিরাপদে আছে ইঞ্জিন রুম, সে বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কোন দপ্তরই মন্তব্য করেনি’।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, ইঞ্জিন আগুনের সূত্রপাতের বড় কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এবং ইঞ্জিনকে কেন্দ্র করে ফায়ার সেফটি থাকার কথা।
আর তাদের তদন্তে আরও অগ্রগতি হলে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ও এটি নিয়ন্ত্রণ না করতে পাওয়ার বিষয়ে প্রধান প্রধান সমস্যাগুলো কোথায় ছিল সে বিষয়েও বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চটির ইঞ্জিন রুমের সেফটি বলতে খাঁচির মতো করা লোহার গ্রিল দিয়ে জায়গাটি আটকিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন সেফটিই চোখে পড়েনি। গ্রিল দিয়ে রাখা সেই কক্ষটির চারিপাশে ছিল কিছু ভরা তেলের ড্রাম। আর ইঞ্জিন রুমের কাছাকাছি একটি টি-শপ রয়েছে। যেখানে গ্যাসের ও কেরোসিনের চুলায় চা-বানানোর কাজ চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। আর ওই দোকান থেকে যারা সরাসরি সিগারেট কিনেছেন তারাও ইঞ্জিন রুমের পাশে দাঁড়িয়েই ধোঁয়া ছেড়েছেন। এছাড়া ইঞ্জিন রুমের পেছনের দিকটাতে মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে খাবার ক্যান্টিন বা হোটেলের অবস্থান। এর পাশেই গ্যাসের চুলাতে লঞ্চ ছাড়ার পরও চলে রান্না-বান্নার কাজ। সুন্দরবন-১১- এর লঞ্চের চালক আবদুস সালাম মৃধা বাংলানিউজকে বলেন, বড় লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে রান্না ঘরের দূরত্ব বেশি থাকলেও ছোট আকৃতির লঞ্চগুলোতে রান্না ঘর একদম লাগানো থাকে। আর তাই রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তো লঞ্চগুলোতে থেকেই যায়।
বরিশাল-ভোলা রুটের যাত্রী শাওন বাংলানিউজকে বলেন, লঞ্চগুলোর যেখানে ইঞ্জিন রুম সেখানেই তো তেলের রিজার্ভার থাকে। আর সেই ইঞ্জিন রুমের পাশেই ক্যান্টিন-হোটেল বসার ব্যবস্থা খোদ লঞ্চ কর্তৃপক্ষই করে দেয়। ছোট লঞ্চগুলোর ক্যান্টিনগুলোতে তো ইঞ্জিন রুমের গা ঘেঁষেই,সেখানে শুধু চুলা জ্বলে এমনটা নয়, যাত্রীরা বিড়ি-সিগারেটও সেবন করছে সেখানে থেকে। এতে পুরো বিষয়টিই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
ইঞ্জিন রুমের কাছাকাছি রান্নার ব্যবস্থা করা কোন নিয়মের মধ্যে নেই বলে জানিয়েছেন বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তারা। অপরদিকে ইঞ্জিন রুমে রিজার্ভ তেল থাকায় সেখানে যে ধরনের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি থাকার কথা তাও থাকে না বেশিরভাগ সময়। বিশেষ করে ফোমটাইপ ফায়ার এক্সটিংগুইসারের উপস্থিতি সব ধরনের লঞ্চেই কম। অথচ তেল জাতীয় পদার্থের আগুন নেভাতে ফোমটাইপ ফায়ার এক্সটিংগুইসার আর বৈদ্যুতিক লাইনে বা যন্ত্রপাতিতে আগুন ধরলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা ড্রাইকেমিক্যাল পাউডারের এক্সটিংগুইসার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
তারা বলছেন ইঞ্জিন রুমে এ দুই ধরনের এক্সটিংগুইসার-ই থাকা প্রয়োজন। তবে, ইঞ্জিন রুমের যারা দায়িত্বে তারা শুধু জানেন অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় তাদের কাছে সিলিন্ডার (এক্সটিংগুইসার), পানি আর বালু রয়েছে। তবে, এগুলোর কোনটি কি ধরনের আগুন নেভাতে সাহায্য করে তা বরিশাল-বরগুনা রুটের লঞ্চের স্টাফরা জানাতে পারেননি। আর লঞ্চে খাবার রান্নায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হলেও সেখানে রাখা হয় না এক্সটিংগুইসার, চটের ব্যাগ কিংবা কাপড়।
এ ঘটনার পর প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে যাচ্ছেন নৌযান শ্রমিকরা। নৌযান মালিকরা না চাইলে লঞ্চের কর্মীদের জন্য অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা মহড়ার ব্যবস্থা ফায়ার সার্ভিস করে না।
অনীহার কারণে গত দুই বছরের মধ্যে শুধু ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলা এমভি মানামী লঞ্চে একবার অগ্নিমহড়া করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পুড়ে যাওয়া নৌযানটি পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে এখন আমরা আছি। এখন তথ্য-সংগ্রহ করার পাশাপাশি ঘটনাস্থল, লঞ্চসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করছি। পুরো কাজটি শেষ হতে দুই সপ্তাহ লাগবে। দুই সপ্তাহ পরে আমরা আপনাদের একটি ধারণা দিতে পারবো যে সম্ভাব্য কোন কারণে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয় অথবা অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল কিনা। তবে, প্রাথমিকভাবে যেটুকু বলতে পারি তা হলো, অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর আমরা যখন জাহাজের কাছে ফায়ার ফাইটিংয়ে আসি, তখন আমরা সম্পূর্ণ লঞ্চে আগুন জ্বলছে এমনটা দেখতে পাই। সামনে থেকে পেছন, ওপর থেকে নিচ পুরোটাই আগুনে জ্বলছিল। তিনি বলেন, চলমান লঞ্চে চালক বা ম্যানেজমেন্টোর যারা ছিল তারা রাতের বেলা থাকায় হয়তো আগুন যথাসময়ে আইডেন্টিফাই করতে পারেনি, অথবা আগুন যখন প্রাথমিক অবস্থায় ছিল তখন তারা কার্যকারীভাবে ফায়ার ফাইট করতে পারেনি। ফায়ার ফাইট যে তারা করতে পারেনি এর প্রমাণ ৩৬ জনের ওপরে মৃত্যু এবং ৬৫ জনের ওপরে আহত হওয়া।
এটা অফিসিয়ালি বলা যায়, তাদের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকরী খুব একটা ছিল না, আর যারাও এখানে দায়িত্বে ছিলেন তারা ঘটে যাওয়া ফায়ার ইনসিডেন্ট ম্যানেজ করতে পারেননি।
তিনি বলেন, যেহেতু জাহাজটি নদী দিয়ে চলাচল করে তাই পানিটা সহজলভ্য। সেই নদী থেকে ফায়ার পাম্প দিয়ে প্রতিটি ফ্লোরে হোজ পাইপের মাধ্যমে ফায়ার ফাইট করা যায়। এছাড়া লঞ্চে পর্যাপ্ত এক্সটিংগুইসারও থাকার কথা। ফায়ার সেফটির বিষয়গুলো আমরা দেখবো। জলযানটি তৈরির সময় ফায়ার সেফটির ব্যবস্থাগুলো ছিল কিনা সেটা দেখতে হবে। সেসঙ্গে ফায়ার সেফটির বিষয়গুলো যদি ইনস্টল করা থাকে, তাহলে কার্যকরী করে রাখাটাও বিষয়। তাই তাও দেখা হবে।
আপনারা জানেন যেকোনো যন্ত্র নির্দিষ্ট সময় পরপর পরিবর্তন করে সচল করতে হয়। যা ফায়ার সেফটি সরঞ্জামের বেলাতেও এক। এক্সটিংগুইসার প্রতিবছরই পরিবর্তন করতে হয় এবং অন্যান্য সরঞ্জামও প্রতিনিয়ত চেঞ্জের মাধ্যমে কার্যকরী রাখতে হয়। যন্ত্র মানেই ত্রুটি হতে পারে আর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব তা প্রতিস্থাপন করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২১
এমএস/এএটি