ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জুন ২০২৪, ২০ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

লাল পতাকা উড়িয়ে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করা সেই গেটকিপার পুরস্কৃত

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২
লাল পতাকা উড়িয়ে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করা সেই গেটকিপার পুরস্কৃত

পাবনা (ঈশ্বরদী): রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নন্দনগাছি আড়ানি রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রেললাইন ভাঙা দেখে লাল পতাকা উড়িয়ে দুর্ঘটনার হাত থেকে ট্রেনকে রক্ষা করা গেটম্যান লায়েব উদ্দিন (৫২) কে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করে পুরস্কৃত করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের পাকশী রেলওয়ে বিভাগ।

মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিকাল সাড়ে ৫ টায় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) কার্য্যলয়ের কনফারেন্স রুমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সম্মাননা দেওয়া হয়।

শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টা ৫২ মিনিটে দিনাজপুরের পার্বতীপুর জংশন স্টেশন থেকে ছেড়ে রাজশাহী অভিমূখে আসা 'উত্তরা এক্সপ্রেস' নামে ওই মেইল এক্সপ্রেস ট্রেনটি তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে রাজশাহী দিকে যাচ্ছিলেন। শুধুমাত্র রেলওয়ে গেট-কিপারের বুদ্ধিমত্তা এবং কর্মদক্ষতায় ট্রেনটি দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

গেটকিপার লায়েব উদ্দিন আড়ানী পৌরসভার ১ নাম্বার ওয়ার্ডের কুশাবাড়িয়া গ্রামের শুকুর আলীর ছেলে।  সে ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেলরুটে আড়ানী-পুঠিয়া মহাসড়কে অস্থায়ী গেটকিপার হিসাবে কর্মরত।

ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেলরুটের দায়িত্বরত প্রকৌশলী পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান,শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯ টা ৫২ মিনিটের সময় তিন শতাধিক যাত্রীদের নিয়ে পার্বতীপুর থেকে রাজশাহী আসছিল 'উত্তরা এক্সপ্রেস 'নামে মেইল ট্রেন। এসময় ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেলরুটের আড়ানি স্টেশনের দুই কিলোমিটার দূরে আড়ানি-নন্দনগাছি স্টেশনে ১৪ নাম্বার ব্রিজের কাছাকাছি ১২ ইঞ্চি রেললাইন ভেঙ্গে বিপদের মুহূর্তে পড়তে যাচ্ছিল। ওই গেটকিপার লায়েব উদ্দিন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সাহসিকতার যে প্রতিদান! সেটা আমরা হয়তো দিতে পারব না। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহা-ব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার স্যারের নির্দেশে গর্বিত সৈনিককে সম্মাননা প্রদান করছি।

প্রকৌশলী আব্দুর রহিম আরও জানান,লায়ের উদ্দিন বিনাশ্রমে দীর্ঘদিন ধরে ঈশ্বরদী রাজশাহী রেলরুটের আড়ানী-পুঠিয়া সড়কের রেলওয়ে ক্রসিং গেটে গেটম্যান হিসাবে কাজ করেছেন দেশপ্রেমের টানে। দেশপ্রেমিক লায়েবের ডিউটি না থাকলেও তিনি বসে ছিলেন অবসর সময়ে। ওই লাইন দিয়ে মালবাহী ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর বিকট একটা আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে রেল ভাঙ্গা দেখতে পান।  

তার সাহসিকতায় বড় দুর্ঘটনা থেকে ট্রেন রক্ষা পেয়েছে। পাকশী রেলবিভাগ এটা জানার পর চলতি বছরের ১ জানুয়ারী তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৪/১৫ বছরে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে দায়িত্ব পালন করে প্রমান করেছেন, তিনি দেশ, জাতির জন্য কাজ করা মহৎ মনের মানুষ।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহী মহা-ব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বাংলানিউজকে জানান, লায়েব উদ্দিনকে সংবর্ধিত করতে পেরে আমরাই নিজেরা সম্মানীত হয়েছি। তার,যে দায়িত্ববোধ,তার অগাধ যে ভালোবাসা মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার পেক্ষিতে লায়েব কিন্তুু ট্রেনটি থামিয়ে দিয়েছেন একটা খারাপ অবস্থা থেকে। আমরা ছোট করে হলেও সংবর্ধনা দিতে পেরেছি! 

জিএম অসীম কুমার তালুকদার আরও বলেন, এই সংবর্ধনার মাধ্যমে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য একটি বার্তা,সেটা হলো-যারা (রেলকর্মচারী) দায়িত্বের সাথে ভালো কাজগুলো করবেন, এই দায়িত্ব আমাদের তাদের সম্মানীত করা,সেটা করে যাব সবসময়।

গেটকিপার লায়েব প্রমানিক বাংলানিউজকে জানান, শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ওই রেলরুট দিয়ে মালবাহী ট্রেন যাওয়ার পর এক বিকট শব্দ কানে আসে। এমন শব্দ আগে কখনোই শুনিনি। ওই সময় আমি দৌড়ে গিয়ে দেখতে পাই, রেললাইন ভেঙ্গে গেছে। তখন আমার ডিউটি ছিল না। আমি দৌড়ে আমার নিজের কাছে থাকা লালকাপড় উড়াতে থাকি। সংকেত দেখে ট্রেনের লোকোমাষ্টার (চালক) দ্রুতই ট্রেনটি থামিয়ে দেন ভাঙ্গা থেকে ৫০০ মিটার দূরে। এতে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা মেলে উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদের।  


দেশপ্রেমিক লায়েব উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান,২০১০ সালের দিকে একমাসের মধ্যে ৩ জন মারা যায়। 'এটা দেখার পর কষ্ট লেগেছিল;। তখন দুটি বাঁশ কিনে দিয়ে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে আসছিলাম। পাশাপাশি কৃষি কাজের সাথে জড়িত ছিলাম।  

লায়েব উদ্দিন আপরও জানান,অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না বলে লেখাপড়া করতেই পারিনি। অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি বলে এক মেয়েকে রাজশাহী কলেজ থেকে মাষ্টার্স শেষ করেয়েছি। আরেক মেয়ে মাষ্টার্স পড়ছে। ছোট মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে। আমরা মোট ৫ ভাই ৪ বোনের মধ্যে আমি চতুর্থ সন্তান।  


দেশপ্রেমিক গেটকিপার লায়েব উদ্দিন জানান, আমার দুটি মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। যাি পরিবারে একটি মেয়ের চাকুরীর একটা ব্যবস্থা করে দেন কোন রেল কর্মকর্তা!  তাহলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।  


সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন,পাকশী পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) আনোয়ার হোসেন, পাকশী বিভাগীয়  সংস্থাপন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন, পাকশী রেলওয়ের প্রকৌশলী-১ বীরবর মণ্ডল, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী-২ আব্দুর রহিম, পাকশী বিভাগীয় বানিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন, পাকশী বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ) মমতাজুল ইসলাম, পাকশী বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) আশীষ কুমার মণ্ডল,পাকশী বিভাগীয় বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী রিফাত শাকিল,পাকশী বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী এম এম রাজিব বিল্লাহ, সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (টেলিকম)সৌমিক শাওন কবির, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কিরণ, দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রতিনিধি মাহবুবুল হক দুদু, দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি তৌহিদ আক্তার পান্না, বাংলানিউজটোয়িন্টফোর.কমের প্রতিনিধি টিপু সুলতান।  

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৭ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২
এমএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।