ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

‘সবাই ফিরল সুন্দর কাপড়ে, তুই আইলি কাফনে’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২২
‘সবাই ফিরল সুন্দর কাপড়ে, তুই আইলি কাফনে’ মরদেহ নিতে এসে বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাদিসুরের খালা শিরিন আক্তার মমতাজ | ছবি: জি এম মুজিবুর

ঢাকা: ‘দেশে আইবি, কথা ছিল তোরে শেরওয়ানি পড়ামু, বিয়া করামু। কিন্তু কাফনের কাপড় পইড়া কেন আইলি বাবা হাদিসুর..., আমি এখন কারে শেরওয়ানি পড়ামু? তোর লগের সবাই ফিরা (ফিরে) আইলো কিন্তু তুই আইতে পারলি না বাবা।

শেষে আইল তোর লাশ। ওরে হাদিসুর রে... এমন কেন করলি রে... বাবা?’

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের সামনে হাদিসুরের মরদেহ দেখে আহাজারি করে এসব কথা বলছিলেন নিহত ইঞ্জিনিয়ার হাসিদুর রহমানের ছোট খালা শিরিন আক্তার মমতাজ।

তিনি বলেন, এবার হাদিসুর ফিরে এলেই তার বিয়ে করানোর কথা ছিল। আমরা মেয়ে দেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু কে জানে হাদিসুর না, তার লাশ ফিরা আইবো!

হাদিসুর বলেছিল, খালামনি তুমি অনেক অসুস্থ। তোমার নিজের যত্ন নিও। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কইরো। আমি তোমার কথার অবাধ্য আর হবো না। গতবার কইছিলা বিয়ে করাবা, করি নাই। কিন্তু এবার দেশে ফিরে এসেই বিয়ে করবো। তোমরা মেয়ে দেখে ঠিক করে রাখো, বিলাপ করে বলেন হাদিসুরের  খালা।

তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর আগের দিন রাতেও হাদিসুরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আমার কথা হয়েছিল। ওই সময় হাদিসুর বলেছিল, আমরা খুব বিপদে আছি। জাহাজ নিয়ে যেতে অনেক সতর্ক থাকতে হচ্ছে। আমাদের এক মাসের খাবার মজুদ আছে। খাওয়ার কষ্ট নাই। আমরাও সাবধানে আছি, তোমরা চিন্তা কইরো না খালা।

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় নিহত ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’র থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ সোমবার (১৪ মার্চ) দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে রোমানিয়া থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। মৃত্যুর ১২ দিন পর হাদিসুরের মরদেহ দেশে ফেরত আনা গেল। আনুষ্ঠানিক সব প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ নিয়ে দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে হাদিসুরের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগীর উদ্দেশে রওয়ানা করেন তার স্বজনরা।

হাদিসুরের মরদেহ নিতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসেছিলেন তার ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স, তার চাচা মিজানুর রহমান জীবন, খালা শিরিন আক্তার মমতাজ ও খালাতো ভাই সোহাগ হাওলাদার। তাদের সঙ্গে বরগুনা ২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনও ছিলেন।

এ সময় হাদিসুরের খালাতো ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ভাই সবাইকে কইলো কেউ উপরে যাবি না, আর সবার আগে সে উপরে চলে গেলো। ওরে ভাই, আমার ভাই। সবাই ফিরে আইলো খালি তুই আইলি নারে ভাই, তোর লাশ আইলো!

মরদেহ বিমানবন্দরের আসার পর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে বিমানবন্দরের ভেতরে যান হাদিসুরের চাচা মিজানুর রহমান জীবন ও সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন। এ সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং জাহাজ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা।

হাদিসুর রহমানের চাচা মিজানুর রহমান জীবন বাংলানিউজকে বলেন, হাদিসুরের ভিটা-বাড়ি অনেকটাই ভাঙাচোরা। তার ইচ্ছা ছিল, সে এই ঘরটা মেরামত করবে, কিন্তু পারলো না। তার ছোট দুই ভাইকে পড়া-লেখা করাবে, সেটাও সম্ভব হলো না। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল হাদিসুর।

গত ২ মার্চ ইউক্রেনে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। ৩ মার্চ অক্ষত অবস্থায় জাহাজটি থেকে ২৮ নাবিককে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে তাদের নিরাপদ বাঙ্কারে রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের প্রথমে মলদোভা, পরে রোমানিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। গত ৯ মার্চ ২৮ নাবিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ইউক্রেন থেকে ২৮ নাবিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও হাদিসুরের মরদেহ তখন দেশে আনা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২২
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।