ঢাকা, সোমবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সংসারের দায়িত্ব শিশু আরিয়ানের কাঁধে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২২
সংসারের দায়িত্ব শিশু আরিয়ানের কাঁধে

বাগেরহাট: আরিয়ান, পুরো নাম আরিয়ান রহমান আলিফ। বয়স সাত।

পড়াশোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে। এই বয়সেই পড়াশুনার পোশাপাশি অসুস্থ মা ও নিজের খাবারের জন্য কাজ করেন মানুষের বাড়িতে। যখন কাজ থাকে না, তখন গ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে কলার মোচা ও শাক তুলে বিক্রি করেন বাগেরহাট শহরে। যা পায়, তাই দিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলে মা-ছেলের সংসার।

অসহায় ছোট্ট শিশু আরিয়ান মা আমেনা আক্তার পিয়ার সঙ্গে থাকেন বাগেরহাট সদর উপজেলার ভাটসালা গ্রামের নানা মো. সাইখুল ইসলামের বাড়িতে। আরিয়ান গর্ভে থাকার সময় মা আমেনা আক্তারকে ফেলে চলে যান বাবা খলিলুর রহমান। মামালা, থানা পুলিশ শেষে সরকারি হেফাজতে দিন কাটিয়ে অবশেষে বছর পাঁচেক আগে ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়ি ভাটছালায়। বাবার ঘরে সৎ মা থাকায় নানা লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করতে হয় আরিয়ানের মাকে। এক পর্যায়ে মো. সাইখুল ইসলাম মেয়ে ও মেয়ের ছেলেকে নিজের ঘরের সামনে টিনের ছাপড়া দিয়ে আলাদা ঘর তৈরি করে দেন। মানুষের বাড়ি কাজ করে এবং চেয়ে চিন্তে ছেলেকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে আমেনার। এরই মাঝে আরিয়ানকে ভাটসালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। কিন্তু অযত্ন, অবহেলা, মানসিক-আর্থিক কষ্ট ও না খেয়ে থেকে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়েন আরিয়ানের মা আমেনা আক্তার পিয়া। মা যখন আর বাইরে কাজ করতে পারেন না, তখন আরিয়ান স্থানীয় ডোবা থেকে শাক ও বিভিন্ন বাগান থেকে কলার মোচা নিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন শহরে। তাতেও প্রতিদিন একবেলা ভাত জোটেনা অসহায় এই মা ছেলের।

আরিয়ান রহমান আলিফ বলেন, মা তেমন কাজ করতে পারে না। তাই আমি শাক তুলে এবং মোচা নিয়ে বিক্রি করতে যাই। এক আঁটি শাক ১০ টাকা বিক্রি করি। অনেক সময় ৫ টাকা দিয়েও এক আঁটি নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে যে যা দেয়, তাতেই দিয়ে দেই। এর বাইরে এলাকার লোকজন ইট টানা, পানি নেওয়াসহ যেকোনো কাজে ডাকলে আমি যাই। অনেক সময় ২০-৫০ টাকা দেয়, আবার কিছু খেতে দিয়েই শেষ করেন কেউ কেউ।

এসব কাজ করে ঠিকঠাক মত চলে দুইজনের খাওয়া দাওয়া এমন প্রশ্নে আরিয়ান বলেন, ওই যা পাই তাই দিয়ে চলে। যেদিন চাইল আনতে পারি ওইদিন খাই, যেদিন আনতে পারি না ওই দিন খাই না। শুধু ভাত হলেই চলে আমাদের, লবন দিয়ে খেতে পারি আমি এই বলে হেসে দেয় আরিয়ান।

আরিয়ানের মা আমেনা আক্তার প্রিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিয়ের পরে স্বামী ও দেবররা খুব মারধর করতো আমাকে। ঘরে সৎ মা থাকায় বাবাও খোঁজ নেয়নি। একবার মেরে মাথার মগজ বের করে দিয়েছিল আমার স্বামী। আরিয়ান আমার গর্ভে আসার একমাস পরেই ছেড়ে চলে যায় আমার স্বামী খলিলুর রহমান। মামলা করেছিলাম আদালতে, অভিভাবক না থাকায়, আদালত থেকে আমাকে সরকারি হেফাজত খানায় দিয়ে দেয়। সেখানেই আরিয়ানের জন্ম হয়। পরে চলে আসি বাবার বাড়িতে, সেখানে এসে সৎ মা ও প্রতিবেশীদের অত্যাচার সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত।

আমেনা আক্তার আরও বলেন, নিজের জন্য আমি কিছুই চাই না। আমি চাই আমার ছেলেটা লেখা পড়া শিখুক ও তিন বেলা খেয়ে পড়ে বাঁচুক। ওর জন্য একটি স্থায়ী ঘর চাই যেখান থেকে কেউ নেমে যেতে বলবে না।

এদিকে আরিয়ানের অসহায় জীবনের গল্প শুনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদ। শুক্রবার (২২ এপ্রিল) সকালে বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাছির উদ্দিন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মাদ মুছাব্বেরুল ইসলাম, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীনসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আরিয়ানের বাড়িতে যান। আরিয়ান ও তার মাকে নতুন পোশাক, জুতা, চাল, ডাল, তেল, লবন, মশলা, ফলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য প্রদান করেন। আরিয়ানের মাকে নগদ অর্থও প্রদান করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাছির উদ্দিন।

বাগেরহাট সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মাদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা আরিয়ানের নামে একটি ব্যাংক হিসেব খুলে দিব। আরিয়ানকে কেউ যদি সহযোগিতা করতে চায় ওই হিসাবের মাধ্যমে করবে। এছাড়া আরিয়ানের লেখাপড়া ও মায়ের কর্মসংস্থানের জন্য আমরা বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছি। আরিয়ান ও আরিয়ানের মা যেটা ভাল মনে করবে আমরা সেভাবে তাকে সহযোগিতা করব।

বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাছির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ তন্ময়ের নির্দেষে আমরা আরিয়ানের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে সহযোগিতা করেছি। তাকে একটি সরকারি ঘর প্রদানেরও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। পর্যায়ক্রমের আরিয়ান ও তার মা যাতে স্বচ্ছলভাবে বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থার আশ্বাস দেন উপজেলার এই শীর্ষ জন প্রতিনিধি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।