ঢাকা, শুক্রবার, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রানা প্লাজার স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আহত শ্রমিকদের

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২২
রানা প্লাজার স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আহত শ্রমিকদের

ঢাকা: রানাপ্লাজার ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় রানা প্লাজায় কাজ করা আহত শ্রমিক ও স্বজনদের। আজও অনেকে ঘুমাতে পারেন না।

নয় বছর আগে ঘটে যাওয়া বিভীষিকার সেই সকাল তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের। অনেক শ্রমিক অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। তবে এ ঘটনার দায়ীদের এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।

এজন্য রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আহত ও নিহত যারা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি তাদের দ্রুত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রানার যে সব সম্পত্তি রয়েছে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে আহত, নিহত শ্রমিক পরিবারকে পুনর্বাসন ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, অন্যান্য দিনের মতোই কর্মচঞ্চল আলো ঝলমলে ছিল সেদিনটা। প্রতিদিনের মতই সাভারের রানা প্লাজার আটতলা ভবন জুড়ে ছিল কর্ম ব্যস্ততা। সকাল ৮:৪৫ মিনিট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দ আর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে মুহূর্তেই পুরো ভবনটি ধসে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভবনের কয়েকটি তলা মাটির নিচে চলে যায়। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। নিখোঁজ হন ১৮২ জন শ্রমিক। দেশের পোশাকখাতে স্মরনকালের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিগুলোর একটি সাভারের রানা প্লাজা।

রানাপ্লজার চতুর্থ তলায় আইরনম্যান হিসেবে কাজ করতেন মেহেরপুরের ছেলে ইমাদুল ইসলাম ইমদাত বাংলানিউজকে জানান, রানাপ্লাজা দুর্ঘটনায় ৩৬ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয় তাকে। এরপর এ্যানাম মেডিকেলে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এখনও তার মানসিক চিকিৎসা চলছে। শরীরেও অনেক সমস্যা রয়েছে। আমি এখন কাজ করতে চাই কিন্তু কেউ কাজ দেয় না।

তিনি জানান, ওই দিনের ভয়াবহতা আজও ঘুমাতে দেয় না। সেদিনের বিকট শব্দ, আর্ত চিৎকার আজও তার কানে বাজে। আজো কুঁকড়ে ওঠেন ওইদিনের কথা মনে করে। ঘুমালে মনে হয় বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়তাছে। রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আহত ও নিহত যারা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি তাদের দ্রুত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। আহত অনেকেই কোন কাজ করতে পারে না। কাজ না থাকায় চিকিৎসাও করাতে পারছে না অনেকেই। তাই সরকারকে তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে।

ছেলেকে নিয়ে সাভারে থাকেন মোছাম্মত জেসমিন। ওইদিনের কথা বলতে গেলে আজও গা শিউড়ে ওঠে তার।

তিনি বলেন, ওইদিন যখন জ্ঞান ফিরছে তখন দেখি মাথা ব্যান্ডেজ করা। আমি হাসপাতালে। নড়তে চড়তে পারি না। ডাক্তার কয় আমার মেরুদণ্ডের হাড় ফাইটা গেছে। সেই থিক্যা আমি অসুস্থ। খুবই অসুস্থ। মাথায় আঘাত পাওনে বেশিক্ষণ তাকায় থাকতে পারি না। বেশিক্ষণ বইসা থাকলে পা ফুইলা যায়। পা ফেলাইতে পারি না। আমার এই অবস্থা দেইখা আমার স্বামী আমারে পোলারে ছাইড়া চইলা গেছে।

সাভারে বড়ো বোনের বাসায় থাকেন জেসমিন। মাসে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। মাঝে মধ্যে ওষুধ কিনতে পারেন না বলে ছেদ পড়ে চিকিৎসায়।

তিনি বলেন, চেষ্টা করছিলাম কাজে যোগ দেওনের। কিন্তু শরীর এতো খারাপ লাগে। বাসার কাজই করতে পারি না অনেক সময়। এহনো ঠিক মতো শান্তি কইরা ঘুমাইতে পারি না। ঘুমের ওষুধ খাওন লাগে। ভয় লাগে। মনে হয় বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়বো।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদিপুর ইউনিয়নের বারাইহাট চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী রেবেকা বেগম। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে দুই পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন রেবেকা।

রেবেকা বেগম বলেন, পরিবারের ৭ সদস্য মিলে রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলায় কাজ করছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দে ভবনটি ভেঙে পড়ে। সেই কক্ষেই দুই পা দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে আটকে যায়।

তিনি জানান, দুইদিন পর সেখান থেকে স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করেন।

এদিকে এ ঘটনায় রেবেকা বেগমের পরিবারের দুইজন কোনমতে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও মাসহ বাকিরা হারিয়ে গেছেন রানা প্লাজার ভেঙ্গে পড়া ভবনের ইট পাথরের কংক্রিটের ভেতর।

তিনি জানান, রানা প্লাজার ভবন ধসের পর সরকারি ঘোষণা ছিল যেসব শ্রমিক শরীরের দুইটি অঙ্গ হারিয়েছেন তাদেরকে ১৫ লাখ এবং যারা একটি অঙ্গ হারিয়েছেন তারা ১২ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু রেবেকা বেগম শরীরের দুইটি পা হারালেও তাকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। রেবেকা বেগম একটি পা হারিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের এমন ভুল তথ্যের কারণে রেবেকা সরকার ঘোষিত পুরোপুরি অর্থ পাননি। তবে অনুদানের টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে রেখেছেন। সেই টাকা থেকে প্রতি মাসে যা পান তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলছে। তাকে ও বাচ্চাদের দেখাশুনার জন্য তার স্বামী বাইরে কাজ করতে পারেন না।

রেবেকা বেগম আরও জানান, তার দুই পায়ে চারবার করে আটবার অপারেশন করতে হয়েছে। বর্তমানে দুইপায়ের হাড় বের হয়ে আসায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। চিকিৎসক খুব দ্রুত অপারেশন করতে বলেছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে সেটি করাতে পারছেন না রেবেকা।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কনট্রোর সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক নেত্রী জলি তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, রানাপ্লাজার হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও হয়নি। দুইটি মামলা হয়েছিল। তারমধ্য থেকে একটি মামলার আড়াই ৩ মাস ধরে শুনানি শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের উকিল ও গামেন্টর্স মালিকদের একটা বিরাট গাফলতি আছে। অপরাধীদের বিচার হওয়াটাই প্রধান কাজ। দায়ীদের এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। যারা আহত হয়েছে, যারা মারা গেছে এবং যারা স্থায়ী পঙ্গু হয়েছে তাদেরকে আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

তিনি বলেন, অনেক শ্রমিক অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রানার যে সব সম্পত্তি রয়েছে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে আহত, নিহত শ্রমিক পরিবারকে পুনর্বাসন ব্যবস্থার দাবী জানানো হয়েছিল। আমাদের একটাও দাবি বাস্তবায়ন করা হয়নি।

রানাপ্লাজা ধসের পড়ে মালিকদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, রানাপ্লাজা ধসে পরার পর কোন ওষুধও কাজে লাগেনি। এই ঘটনার পর সারা দেশের মানুষ তাদের একদিনের আয় দিয়ে সহায়তা করেছে। সেখানে ২৭ কোটি টাকা জামা রয়েছে। এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিলে কিছুটা হলেও কমতো। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে রাষ্ট্রিয়ভাবে শ্রমিকদের সহায়তা না করায় দিন দিন শ্রমিকদের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের নিয়ে একশন এইড বাংলাদেশ এ মাসের ১৮ এপ্রিল  একটা জরিপ প্রকাশ করে। এই জরিপ থেকে জানা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে যা গত বছর ছিল ১৪ শতাংশ। গত বছরগুলোতে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেও এবছর অবনতি ঘটেছে। গতবছর যেখানে মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত ছিলেন ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, এবছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশে। ৩১ শতাংশ বলেছেন তাদের মানসিক অবস্থা ‘প্রায় স্থিতিশীল’ এবং ২০ দশমিক ৫ শতাংশ ‘সম্পূর্ণ স্থিতিশীল।

এদিকে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৩ শতাংশ বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৪৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ বলেছেন শারীরিক অক্ষমতার কারণে তারা কাজ করতে পারেন না এবং ১০ শতাংশ এখনও মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বেঁচে যাওয়া ২০০ জনকে নিয়ে একশনএইড বাংলাদেশ এই জরিপ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
জিসিজি/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ