ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ মে ২০২৪, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

বাঁকখালী নদী দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে উত্তেজনা

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫১ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২২
বাঁকখালী নদী দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে উত্তেজনা

কক্সবাজার: কক্সবাজার সদর থানা সড়কের মাথায় শহরের কস্তুরাঘাট এলাকা। পার্শ্ববর্তী খুরুশকুল ইউনিয়নের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কস্তুরাঘাট পয়েন্টে বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছে ৫ দশমিক ৯৫ মিটার দৈর্ঘ্য একটি সেতু।

সেতুটি নির্মিত হয়ে গেলে খুরুশকুল ও বৃহত্তর ঈদগাঁও অঞ্চলের সঙ্গে শহরের বিকল্প সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে।

কিন্তু নির্মিতব্য সেতুটি এখন বাঁকখালী নদীর ওপর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেতুর পাশাপাশি সংযোগ সড়ক তৈরি হওয়ায় সড়কের দুপাশে প্যারাবন ধ্বংস করে নদী দখলের মহোৎসব চলছে। অভিযোগ আছে, নদী দখলের নেপথ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিসহ অনেক রাঘববোয়াল।

জানা গেছে, শনিবার (১১ জুন) জেলা ছাত্রলীগ নেতা আদনান বাঁকখালী নদীর ওপর স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলে তাকে বাধা দেন সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মারুফ নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ। পরে বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষে উত্তেজনা দেখা দেয়।

এ ঘটনার সামাল দিতে ঘটনাস্থলে যান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সদর থানা পুলিশের একটি দল। তারা ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ কাজে বাঁধা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জিল্লুর রহমান।

জিল্লুর রহমান জানান, ওই জায়গাটি তাদের খতিয়ান-ভুক্ত জমি। কয়েকটি গ্রুপ জায়গাটির মালিকানা দাবি করছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। যেহেতু সেখানে প্যারাবন আছে, আপাতত কোনো পক্ষ সেখানে যেতে পারবে না, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনান বাংলানিউজকে বলেন, এটি সরকারি খাস জমি নয়। ২০২১ সালে ৭ শতক জমি আমি কিনেছি। আমার নামে খতিয়ানও আছে। কিন্তু আরেকটি পক্ষ সেখানে মালিকানা দাবি করায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

এসব ব্যাপারে সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মারুফের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ রয়েছে, সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রভাবশালীরা সেতুর আশপাশ দখলে মেতে উঠেছে। ওই জায়গার প্যারাবনের গাছপালা কেটে, নদী থেকে বালু তুলে তীরের জলাভূমি ভরাট করে প্লট তৈরি করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে অনেকগুলো স্থাপনাও।

এসব দখল-বেদখলের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর দুটি মামলা দায়ের করে। কিন্তু তারপরও দখলদারিত্ব থেমে নেই।

বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কস্তুরাঘাট ও নুনিয়ারছড়া এলাকায় বাঁকখালী নদীর তীরে ৬০০ হেক্টর প্যারাবন রয়েছে। এ বন প্রায় ২০৫ প্রজাতির পাখ-পাখালি ও জলজপ্রাণীর আবাসস্থল। অন্তত দুই দশক আগে ওয়েস্কা ইন্টারন্যাশনাল নামে জাপানের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন এলাকাটিতে প্যারাবন সৃজন করেছিল।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, এভাবে প্যারাবনের গাছপালা উজাড়ের কারণে বিভিন্ন প্রাণী ও পাখির আবাসস্থল সংকটের পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীব-বৈচিত্র্য। এছাড়া তীর ভরাটের কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে নদীর গতিপথ।

সরেজমিন দেখা গেছে, শহরের কস্তুরাঘাট থেকে সংযোগ সড়ক ধরে এগিয়ে যেতেই প্যারা বনের ভেতরে অসংখ্য টিনের ঘর। পাকা স্থাপনাও করা হয়েছে একাধিক।

সেতুর কাছে প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে টিন দিয়ে ঘিরে রেখেছেন স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি। নদী থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে জায়গাটি ভরাট করা হয়েছে। এরপর প্লট বানিয়ে একেকটি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি।

বাকঁখালী নদীর দখল ও দূষণ বন্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটিসহ (ইয়েস) বেশ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন আন্দোলন করে আসছে।

২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বেলার এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট বাকঁখালী নদী দখলদারদের তালিকা তৈরি করে উচ্ছেদ ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধের আদেশ দেন। পাশাপাশি যেকোনো উদ্দেশ্যে নদীর জমি ইজারা থেকে বিরত থাকতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

ইয়েস’র প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, গত দুই মাসে কস্তুরাঘাট এলাকায় প্যারাবনের প্রায় ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইনগাছ কেটে শতাধিক টিনের ঘর তৈরি করা হয়েছে। প্রকাশ্যে এ দখল তৎপরতা চললেও প্রশাসন তা বন্ধে তৎপর নয়। এতে দখল ও দূষণে নদীর গতিপথ সংকুচিত হয়ে আসছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা জানান, দখলদারদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। তারপরও প্যারাবন দখল ও দূষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে নিয়মিত অভিযানও চালানো যাচ্ছে না।

বাপা’র কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ এবং কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু জানান, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট দিয়ে এক সময় চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সঙ্গে জাহাজ চলাচল ছিল। এ ঘাটই ছিল পৌরশহরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। কস্তুরাঘাট থেকে খুরুশকুল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরে দখল, দূষণ এবং ভরাটের কারণে এখন এ নদীর কোথাও ৪০০ মিটার, কোথাও ২০০ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। শহরের সাত কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দখলের কারণে নদীটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২২
এসবি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।