ঢাকা, সোমবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ জুলাই ২০২৪, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

‘আমারে একটা পেকেট দেউকা, ঘরো কোনো খানি নাই’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৬ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০২২
‘আমারে একটা পেকেট দেউকা, ঘরো কোনো খানি নাই’ খাবারের খোঁজে নৌকা নিয়ে ঘুরছে শিশুটি। ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম

সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে: সুনামগঞ্জের তাহিরপুর চেয়ারম্যান ঘাট থেকে বোলাই নদীর বুক চিরে হাওরে ঘণ্টা দু’য়েকের পথ হয়ে আমাদের ত্রাণবাহী তরী (ইঞ্জিনচালিত পর্যটকবাহী নৌকা) থামলো লামার গাঁও এলাকার কলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। স্কুলটির আঙ্গিনা এখনও বানের জলে ডুবন্ত।

স্কুলের বারান্দায় এসে ভিড় করেছে দুই শতাধিক বানাভাসি মানুষ।  

স্বেচ্ছাসেবকরা নৌকা থেকে ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছে, স্থানীয় বাসিন্দা আজমত আলীর সহায়তায় বানভাসি মানুষরা তা সংগ্রহ করছিলেন। আমি তরীর ছাদে উঠে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে তা দেখার চেষ্টা করছিলাম। মাঝেমধ্যে একটা, দুটো ক্লিকও হচ্ছিল। এই করতে করতে চোখ গেল মাঝ হাওরে। দূরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, ক্রমাগত তা এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর তা আরও স্পষ্ট হলো এবং সামনে এলো।  

মিনিট ১৫ এর মধ্যে আমাদের তরীর পাশে এসে ভিড় করলো ছোট আরেকটি তরী। সেটির মাঝিও ছোট মানুষ। তার বয়স হবে ৭ বা ৮। এসেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলো নানাভাবে। বলল ‘আমারে একটা পেকেট দেউকা, আইজ কত দিন ধরি ঘরো কোনো খানি নাই’ (আমারে একটা প্যাকেট দেন আজ কত দিন ঘরে কোনো খাবার নাই)।

ছেলেটার এমন আকুতি আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা ফেলতে পারেননি। একটি সাধারণ খাবারের প্যাকেট ও একটি শিশু খাদ্যের প্যাকেট দেওয়া হয় তাকে। খাবারের দুটো প্যাকেট পেয়ে সেকি আনন্দ শিশুটির চোখে-মুখে। মনে হচ্ছিল তার দু’চোখে আনন্দ খেলা করছে। হাসতে হাসতেই আবার নৌকার বৈঠা বাইতে শুরু করলো শিশুটি। বৈঠা বেয়ে ফিরছে আর আমরা ভাবছি এ বয়সের শিশুরা মায়ের কোলে থাকে আর এ শিশুটি অথৈ জলের মাঝে একটি খাবারের জন্য নৌকার বৈঠা বাইছে? আমাদের সঙ্গে থাকা স্থানীয় তাহিরপুর এলাকার বাসিন্দা আজমত আলী জানালেন, ছেলেটি নৌকা চালিয়ে এক কিলোমিটার দূর থেকে এসেছে। বানের জলে তাদের ঘর ভেসে গেছে। একটি স্কুলে আশ্রিত আছে তারা। মানুষের সাহায্য দান-অনুদানে তারা দিন পার করছে।  

তাহিরপুরে বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দফায় দফায় আঘাত হানা বন্যায় সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে শিশুরা। ক্ষুধার কষ্টে শিশুরা হাহাকার করছে। কিছু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পানিবাহিত রোগেও আক্রান্ত শিশুরা। এছাড়াও বন্যার কারণে স্কুল তো দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ।  

হাওরের আনন্দ নগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ত্রাণবাহী তরী দেখে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ জড়ো হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক শিশু রয়েছে।

শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যার পর থেকেই তাদের সন্তানরা ডায়রিয়া, জ্বর-সর্দি, কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। চারিদিকে পানি হাসপাতালে নেওয়ারও কোনো উপক্রম নেই।

উপেদপুর এলাকায় কবির আহম্মদ, আজগর আলী, আবদুর রাজ্জাকসহ বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের স্কুলগামী সন্তানরা আজ দুই সপ্তাহের অধিক সময় স্কুলে যেতে পারছে না। রাস্তা-ঘাট পানিতে ডুবন্ত, স্কুলগুলোও জলমগ্ন। এমন অবস্থায় নিজেদের সন্তাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছেন তারা।  

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এস এম আবদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, চলতি মাসের ১৬ তারিখ থেকে জেলার ১ হাজার ৪শ ৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে। এ স্কুলগুলোতে প্রায় তিন লক্ষাধিক শিশু পড়ালেখা করে থাকে।  শিশু বন্যার কারণে ঝরে পড়তে পারে তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও তিনি বলছেন এই বন্যায় শিশুরা নানা দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৬ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।