ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন যুদ্ধে সঙ্গী হয়েছে ব্র্যাক

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১২ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০২২
গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন যুদ্ধে সঙ্গী হয়েছে ব্র্যাক

টঙ্গি (গাজীপুর) থেকে ফিরে: মাত্র ১১ বছর বয়সে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন পারুল আক্তার। এখন তার বয়স ২৩।

একটি ছোট্ট দুষ্টু-মিষ্টি মেয়েও আছে। তবে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। জীবন এখন তার কাছে একটা যুদ্ধের নাম।

শুধু পারুল আক্তার নয়, তার মতো অসংখ্য গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাছে জীবন মানেই লড়াই। তাদের প্রতিটা মুহূর্ত পার করতে হয় সংগ্রামের মধ্যে। এবার তারা সেই লড়াইয়ের সঙ্গী পেয়েছন। নিজের ভিটেবাড়ি ছেড়ে এই ব্যস্ত শহরে খুঁজে পেয়েছেন বেঁচে থাকার আনন্দ। এই আনন্দের কারণ হয়েছে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ব্র্যাকের ‘এম্পাওয়ারিং দ্য রেডিমেইড গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স লিভিং ইন আরবান স্লামস অব ঢাকা’ শীর্ষক প্রকল্পটি রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষ করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় আইন ও চিকিৎসা সহযোগিতা, মাসিক সঞ্চয় এবং শ্রমিকদের শিশুর জন্য ডে-কেয়ার সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে ব্র্যাক উন্নত করতে শুরু করেছে এই গার্মেন্টসের কর্মীদের জীবন।

রোববার (৩ জুলাই) গাজীপুরের টঙ্গিতে এই সংক্রান্ত ব্র্যাকের একটি ওয়ানস্টপ সার্ভিসে দেখা মেলে এই বিষয়গুলোর। এখানে একদিকে যেমন কর্মীদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, ঠিক তেমনি তাদের শিশুদের ডে কেয়ারে রাখার ফলে দীর্ঘক্ষণ কাজের সুযোগ পাচ্ছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। এছাড়া একই জায়গায় আরও কিছু সাহায্য পাওয়ায় তারা এটিকেই বেছে নিয়েছেন জীবন যুদ্ধের সঙ্গী হিসেবে।

সেই জীবন সংগ্রাম আর সঙ্গীর কথা বলতে গিয়ে পারুল আক্তার বলেন, 'নিজের মেয়েকে নিয়ে এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি। গার্মেন্টেসে কাজ করে ৩ লাখ টাকা দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে একটা ঘর করলেও আমার এখন ঘর নেই। স্বামীও খোঁজ নেয় না। এদিকে মেয়ের আর আমার ব্যয়ভারও বহন করে না দীর্ঘদিন। এমন সময় ব্র্যাকের সন্ধান দেন এক আপা। এখানে এসে আইন সম্পর্কে জানতে পারি ও এখান থেকেই আইনি সহায়তা নিয়ে মামলা করি। এখন মামলা চলছে এবং এখানকার আইনজীবীরাই সাহায্য করছেন। আমাদের মতো সামান্য গার্মেন্টমস কর্মীদের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। ’

প্রাপ্তির শেষ এখানেই নয়। এই মানুষগুলোর জন্য আছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসা সহযোগিতা কার্যক্রম। এমন কথা জানালেন প্রশিক্ষণ নিতে আসা মেঘলা। কথা হলে বললেন, করোনার আগে আমি যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম, সেখানে আমার বেতন ছিল ৯ হাজার টাকা। এরপর করোনার মধ্যে চাকরি চলে যায়। অনেক খুঁজেও কাজ পাইনি। পরে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খোঁজ পাই। এখান থেকে গার্মেন্টেসের কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন একটি ফ্যাক্টরিতে সাড়ে ১০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। নিজেকে আরও যেন উন্নত করতে পারি, সেজন্য আরও একটি প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আর এই প্রশিক্ষণ থাকার জন্য অফিসেও আলাদা মর্যাদা পাই দক্ষ কর্মী হিসেবে।

কথা এগিয়ে মেঘলা আরও বলেন, এখানে আমার স্বামীকেও এনেছি প্রশিক্ষণের জন্য। আর শরীর খারাপ হলে চিকিৎসাও পাই এখান থেকেই। আপা-ভাইয়ারা বিভিন্নভাবেই আমাদের সাহায্য করেন।  

মেঘলার কথায় সুর মেলান লাভলী খাতুন নামে আরও একজন গার্মেন্ট শ্রমিক। তবে বর্তমানে তিনি আছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। কথা হলে লাভলী খাতুন বলেন, আমি গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই এখানে ডাক্তার দেখাতে আসি। বড় (এমবিবিএস) ডাক্তার আপা খুব ভালোবেসে চিকিৎসা করেন, পরামর্শ দেন।  

এ বিষয়ে ব্র্যাকের এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের চিকিৎসক খলিলুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। যথাসম্ভব ওষুধও সরবরাহ করা হয়। সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা, নবজাতকের যত্ন ও সেবা, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবা, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, বিভিন্ন পরীক্ষাসহ অনেক সুবিধাই দেওয়া হয় এই মানুষগুলোকে।  

আর প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠার বিষয়ে এই কেন্দ্রের সেন্টার লিড নাসরিন আক্তার শশী বলেন, করোনার পর চাকরি না থাকায় এই এলাকার মানুষের মধ্যে প্রশিক্ষণের আগ্রহ বেড়েছে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ভালো ভালো জায়গাতে কাজ করছেন তারা।

ব্র্যাকের এই ওয়ানস্টপ সার্ভিস ঘুরে দেখা যায়, কর্মীরা যেন একটি দীর্ঘ সময় কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন নিশ্চিন্তে, সেদিক বিবেচনা করে দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে পরিচালনা করা হয় একটি ডে-কেয়ার সেন্টার। এখানে বর্তমানে ২৫ জন শিশু রয়েছে যাদের বয়স ১ থেকে ৬ বছরের মধ্যে। এই শিশুদের পড়ালেখা, খাবার, খেলাধুলার উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে এখানেই। এছাড়া এই প্রোজেক্টের আওতায় সকল গার্মেন্ট শ্রমিক যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন, সেজন্য প্রতিমাসে ৩০০ টাকা হিসেবে চালু করে দেওয়া হয়েছে ডিপিস। এতে প্রথম এক বছর প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে সহায়তা দেয় ব্র্যাক।

সার্বিক বিষয়ে কথা হলে ব্র্যাকের আরবান ডেভলপমেন্ট বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মজিবুল হক বলেন, আমরা মূলত ৫০ হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকের জীবন মান ও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। এই ওয়ান স্টপ সেন্টারের মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় আইন ও চিকিৎসা সহযোগিতা, মাসিক সঞ্চয় এবং শ্রমিকদের শিশুর জন্য ডে-কেয়ার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মোট ৩টি সেন্টার কাজ করছে। আমরা আনন্দিত যে, আমরা এই মানুষগুলোর জীবন যুদ্ধের সঙ্গী হতে পেরেছি, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০২২
এইচএমএস/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।