ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

নৌকাডুবিতে প্রাণহানি: করতোয়ার তীরে এখনও শোকের মাতম

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২২
নৌকাডুবিতে প্রাণহানি: করতোয়ার তীরে এখনও শোকের মাতম করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট। ছবি: বাংলানিউজ

বোদা (পঞ্চগড়) থেকে ফিরে: শরতের সকালটা রৌদ্রোজ্জ্বল হওয়ার কথা থাকলেও চারপাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

নদীর ঘাটে সেই নৌকাটি একা দাঁড়িয়ে। যেন দলহারা- অন্ধকার কুয়াশার মাঝে অনুশোচনায় চোখের পানি ফেলছে।  

অদূরে দুই জন এসে হাত নাড়িয়ে মাঝ নদীতে কী যেন দেখাচ্ছিলেন। দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিলো তাদের মাতম। ঘাটের মাঝি জাফর খাঁ জানালেন, প্রতিদিন সকাল হলেই স্বজনকে খুঁজতে আসেন এমন অনেকেই। সপ্তাহ পার হলেও স্বজনদের খোঁজ না পেয়ে এভাবেই মাতম করেন তারা।  

দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনাস্থলের চিত্র এমনই। ২৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬৯টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন এখনও তিনজন নিখোঁজ রয়েছে। এতগুলো মানুষের জীবন যায় এক সময়ের খরস্রোতা করতোয়ার বুকে, সে কারণেই এ নদীর পাড় যেন শোকে স্তব্দ।  

উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের ত্রি-স্রোতা মহা পীঠধাম শ্রীশ্রী বোদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দিরে শারদীয় দুর্গোৎসবের জন্য প্রতিবছর মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়। আরাধনার মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবীকে। সেখানে এক দিনে অন্তত ১০ হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন থেকে বড়শশী ইউনিয়নে মন্দিরে যেতে আউলিয়ার ঘাট দিয়ে করতোয়া নদী পার হতে হয়। পার হতে গিয়েই ঘটে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।  

স্বজন হারানোর বিষয়ে কথা হয় পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ধনীপাড়া গাইঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপক চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, তার পরিবারের ৫ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন সেদিনের ঘটনায়। স্বজনদের হারিয়ে এখন দূর্বিষহ সময় কাটছে তার।

বোদেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে কথা হয় সেপাল চন্দ্র নাথ নামের আরেকজনের সঙ্গে। তিনি জানান, মহালয়ার দিন মন্দিরে আসার সময় সেদিনের ঘটনায় তার মামাতো বোন লক্ষ্মীরানী, বন্ধুয়ানী (বন্ধুর স্ত্রী)- ভাতিজী সুবর্ণা ও পুতুল প্রাণ হারায়।

বোদেশ্বরীর পূজায়ও শোকের ছায়া:
অষ্টমীর দিন সকাল ৯টা। বোদেশ্বরী মন্দিরে চলছিলো পুষ্পাঞ্জলি। মন্দিরে পুরোহিত শাস্ত্র পাঠ করছিলেন। শ’ খানেক ভক্ত ঠাকুরের সঙ্গে কন্ঠ মিলাচ্ছিলেন। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া শেষে পূজার প্যান্ডেলের বাইরে বদেশ্বরী অনাথ আশ্রমের সামনের মাঠে চলছিলো প্রসাদ বিতরণ। পূজা, আরতি সবই ঠিক ঠাক চলছিলো কিন্তু কারোর মুখেই হাসি নেই। সবার মুখেই শোকের ছায়া। আগতরা বলছিলো, ‘আনন্দ কি করে করি। আমাদের স্বজনরা যে করোতোয়ার বুকে পূজার আয়োজনে আসতেই মরেছে। এবার শুধু পূজাই হচ্ছে, আনন্দের আবহ নেই। ’ 
 
পূজা কমিটির সদস্য সৌরভ বলেন, প্রতি বছরের মতো পূজায় সেই জাকজমক নেই। সব যেন ম্লান হয়ে গেছে। এবার আমরা সাউন্ড সিস্টেমটাও বাদ করে দিয়েছি।

মন্ডপের দায়িত্বে থাকা জয় চরণ নামের এক জন জানান, কোনো বাদ্য বাজনা নাই, ডাক দিয়ে শুধু পূজা করেছি, আনন্দ নেই।  

মন্দির প্রাঙ্গণে কথা হয় পাটেশ্বর নামের আরও এক পূণ্যার্থীর সঙ্গে। তিনি জানান, নৌকাডুবিতে তিনি মেয়ে, নাতি ও নাতনিকে হারিয়েছেন। এবারের পূজায় তাই আনন্দ নেই। শুধু পূজা অর্চনাই করছেন। মুখে হাসি ফুটছে না।  

মনি ভূষণ রায় নামের আরেকজন জানান, পূজায় আনন্দ করতে পারছি না। মানুষের জন্য শোকেই আমরা কাতর।  

মিশ্র প্রতিক্রিয়া: 
মহালয়ার মেলায় অংশ নিতে নদী পার হতে গিয়ে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারানোর বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন স্থানীয়রা। কেউ দুষলেন স্থানীয় ঘাটের ইজারাদারদের, কেউ দুষলেন প্রশাসনের নিরবতাকে। আবার অনেকেই জানালেন পারাপারকারীদের অসাবধানতার কথা।  

জাহাঙ্গীর আলম নামের স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসনের বোকামো হয়েছে তাদের সামনেই অতিরিক্ত বোঝাই হয়েছে। বাধা দিলে এমনটা হতো না।  

বোদেশ্বরী প্রাঙ্গণের পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য সৌরভ বলেন, প্রশাসনের কিছু করার ছিলো না। প্রশাসন যথেষ্ট আন্তরিক ছিলো। কিছুটা অবহেলা ছিলো ঘাট মালিকদের। আমরা তাদের কাছে ৬টা নৌকা চেয়েছিলাম। তারা আমাদের তা দিতে পারেনি। না পারার কারণেই মানুষের এমন ভোগান্তি হয়েছে। উপায় না পেয়ে তারা একই নৌকাতে উঠেছেন।  

কথা হয় নৌকাটির বর্তমান মাঝি জাফর খাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, সেদিন দেখেছি মানুষ কতটা অসাবধান ছিলেন। অনেক মানুষকে না করার পরও তারা নৌকাতে উঠে গিয়েছিলেন। অনেকেই নৌকায় উঠে নদীর পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়েছেন। যার ফলে নৌকা হেলেছে-ধুলেছে। এর কারণেই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।  

বর্তমাণে ঘাটের দায়িত্বে থাকা আবদুল খালেক জানান, সেদিন নিজ হাতে তিনি ১৫ জনকে উদ্ধার করেছেন। বেশ কয়েকটি মরদেহ উদ্ধার করেছেন। বিপদে পড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীকেও উদ্ধার করেছেন। খালেক জানান, সেদিন যখন ঘটনা ঘটছিল তখন তিনি হাত পনেরো দূরে ছোট আরেকটি নৌকা চালাচ্ছিলেন। সেদিন প্রশাসন সাবধান করার পরও মানুষ নৌকায় উঠেছিলো। প্রশাসন মাইকিং করে বলেছিলেন ফিরতে। অতিরিক্ত যাত্রী হওয়ায় আর ফেরা হয়নি। মাঝ নদীতেই ডুবতে হয়েছে।  

নৌকার দুই পাশে বসা নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে পানিতে হাত নাড়াচ্ছিলেন। এ সময় নৌকাটি কাত হয়ে এক পাশে পানি উঠতে শুরু করে। ফলে নৌকা হেলে যায়।

তিন কারণে এ ঘটনা: 
মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটার কারণ এক নয় একাধিক। এমনটাই বলছিলেন স্থানীয়রা৷ ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থের ৩০/৪০ ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে সেদিন শতাধিক যাত্রী উঠেছিলেন। এই অতিরিক্ত যাত্রী উঠাকে অন্যতম কারণ বলছেন অধিকাংশ মানুষ।

ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে নৌকাটি মাঝনদীতে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। মাঝি নতুন করে ইঞ্জিন চালু করতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। ইঞ্জিন চালুর পরপরই নৌকাটি দুলতে থাকে। শমশের আলী নামের একজন অভিযোগ করে বলেন, ইজারাদার বেশি টাকার আশায় বেশী মানুষ নৌকায় তুলেছেন।

অতিরিক্ত স্রোতকে আরেক কারণ বলছেন অনেকে। ঘটনার দিন সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুরে বৃষ্টি কমে। একসঙ্গে অনেক যাত্রী নদী পার হতে ঘাটে আসেন। নৌকাটির বর্তমান মাঝি জাফর খাঁ বলেন, নদীতে পানি কমে গেলে প্রায় পাঁচ মাস বাঁশের সাঁকো দিয়ে মানুষ পারাপার করে। বাকি সাত মাস একটি নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার হয়। আউলিয়ার ঘাট থেকে প্রায় ৩০০ মিটার উত্তরে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে বড়শশী ইউনিয়নে বয়ে যাওয়া ঘোড়ামারা নদী। দুটি নদীরই উৎপত্তিস্থল ভারতে। উত্তরে বৃষ্টি হলেই দুই নদী মোহনার পর আউলিয়ার ঘাটে করতোয়ায় পানি ও স্রোত বাড়ে। অতিরিক্ত স্রোতের কারণে সেদিন এতগুলো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।  

স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা প্রশাসন মানুষকে সামাল দিতে পারেনি। মানুষের ভিড়ের তুলনায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের উপস্থিতি ছিল কম। হাজার হাজার মানুষকে এই অল্প কয়েকজন মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।  

প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্য:
বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোলেমান আলী বলেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিলো। ইতোমধ্যে সে কমিটি তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে। ফায়ার সার্ভিস তাদের উদ্ধার অভিযান আপাতত শেষ করেছে। তবে তারা মুভমেন্টে আছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজার জন্য তাদের তৎপরতা চলমান।  

এই কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনা প্রমাণ করে তৃণমূল পর্যায়ে সাতার শেখাটা কতটা প্রয়োজন। ঘাটের মাঝি-মাল্লাদেরও বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার। এ ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় সচেতন না হলে, নিয়ম লঙ্গন করলে প্রাণহানি ঘটতে পারে। পঞ্চগড়ের জন্য এটি একটি ভয়াবহ ট্রাজেডি।  

মর্মান্তিক এ নৌ দুর্ঘটনায় মানুষকে উদ্ধারের জন্য কাজ করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স৷ পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, আমরা টানা ৮দিন উদ্ধারের জন্য কাজ করেছি। যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখান থেকে ৩'শ/৪'শ মিটার দূর থেকেও মানুষের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে। মানুষ যদি নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার কথা সচেতনভাবে ভাবতো তাহলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। এখনও কর্মীরা মুভমেন্টে আছে।  

তদন্ত প্রতিবেদনে যা এলো:
বাংলানিউজের পঞ্চগড় জেলা করেসপন্ডেন্ট সোহাগ হায়দার জানান, এ ঘটনায় সঠিক কারণ অনুসন্ধ্যানে গঠিত তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সোমবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে পঞ্চগড়ের স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের এ তথ্য জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম। জেলা প্রশাসক বলেন, তদন্ত কমিটি তাদের দাখিল করা প্রতিবেদনে ঘাটের ইজারাদারের গাফিলতি, অদক্ষ মাঝি, অতিরিক্ত যাত্রী ও নৌকার ত্রুটিসহ বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে একাধিক সুপারিশও উল্লেখ করা হয়েছে।  

এ তদন্তে সুপারিশ হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে সাঁতার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা, সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো, নিরাপত্তাঝুঁকি বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, ইজারা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের তদারকি বাড়ানো এবং খেয়া ঘাটগুলোতে আরও উন্নত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০২২
এসএইচডি/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।