কুষ্টিয়া: গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আসেন ফ্রান্সের নাগরিক দেবোরা কিউকারম্যান। সাধু সঙ্গ, তাদের জীবনযাপন এবং বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ সম্পর্কে জানার আগ্রহে কুষ্টিয়ায় আসেন তিনি।
এখন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী প্রাগপুরের দিঘিপাড় এলাকার ‘হেম আশ্রমে’ ফকির নহির শাহর শিষ্য হয়ে আছেন। সেখানে নিয়েছেন গুরুর দীক্ষা। আপন করে নিয়েছেন পুরো আশ্রমকে।
গুরুর নির্দেশে ফকির নহির শাহর আরেক শিষ্য রাজনকে বিয়ে করেছেন দেবোরা। এর মধ্যে তিনি শিখেছেন বাংলা ভাষা, পরিবর্তন করেছেন নিজের নাম। দেবোরা কিউকারম্যান থেকে এখন তার নাম দেবোরা জান্নাত। প্রাগপুরের দিঘিপাড় এলাকার তিনতলা একটি বাড়িতে রাজন আর দেবোরা দম্পতির সংসার। মাঝেমধ্যে দেবোরা যান ফ্রান্সে।
২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কিংস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন দেবোরা। পরে দর্শন বিভাগে এমএ পাস করে ফ্রান্সে ইয়োগার শিক্ষকতা করতেন। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। প্যারিসের দেবোরা কুকিয়েমান ও লিন্দা কুঝিয়েমাচারের মেয়ে তিনি।
দেবোরা জান্নাত বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৬ সালে প্রথম লালনের দেশ কুষ্টিয়ায় আসি। লালনের গবেষণার জন্য এসে আমি আর ফিরে যেতে পারিনি। মায়ায় পড়ে গেছি। যার সাধনা করেন, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। তবেই সৃষ্টির এই বিস্ময় জানা সম্ভব হবে। ধর্মের চেয়ে সাঁইজির কাছে মানুষ বড়। ধর্ম কিংবা জাত-পাতের মধ্য দিয়ে নয়, ঈশ্বরকে পেতে হলে, তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে জানা দরকার সুপথের সন্ধান।
তিনি বলেন, কে আমি? আমাকে চিনতে হবে। আমিটা কে? এই সন্ধান করতে হলে গুরুর দীক্ষা নিতে হবে। গুরুর কাছ থেকে জানতে হবে যে কে আমি। মানুষ ভজতে হবে, কিন্তু কোন মানুষ? কেমন মানুষ? সে মানুষ দেখতে কেমন? সেই মানুষের সন্ধান করতে এই দিঘিপাড়ে আমি। ’
ফরাসি টোনে স্পষ্ট বাংলায় ওই নারী বলেন, সংসার হলো সমাজ, সংসার হলো ঘর। এই চিন্তা-চেতনা থেকে ঘর-সংসার করতেই গুরুজির শিষ্যকে বিয়ে করেছি। বাউলদের জীবনাচারে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছি। আর বাংলার মাটি ও বাতাসকে খুব আপন করে নিয়েছি।
দেবোরা জান্নাত বলেন, ২০১৭ সালের দিকে বাবা আর ভাই আমাকে দেখতে এদেশে আসেন। তারা অনেক পছন্দ করেন এখানকার মানুষ ও প্রকৃতিকে। এ দেশের মানুষরা অনেক সহজ-সরল। অনেক ভালো। তাই তারা কোনো আপত্তি করেননি। অনেক দিন হলো আছি। প্রায় ৬ বছর পার হচ্ছে। আমাকে সবাই এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
দেবোরা জান্নাতের স্বামী রাজন বাংলানিউজকে জানান, বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও দেবোরার সঙ্গে আমার খুব ভালো মিল। আমরা দুইজনেই সুখে আছি। আর সে আমার খুব খেয়াল রাখে। আর দেবোরা ফ্রান্সে আর ফিরতে চায় না। এখানকার সবকিছুর মায়ায় পড়ে গেছে সে। দেবোরো পৃথিবীর প্রায়ই ১৫টি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসেছে। সত্য পথ, সৎ মানুষের খোঁজ করতে করতে এই আশ্রমে আসে। সে খুব ভালো মনের একজন মানুষ।
প্রখ্যাত বাউল ফকির নহির শাহর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন দেবোরা। নহির শাহ্ এখন প্রাগপুরের দিঘিপাড় এলাকার হেম আশ্রমে থাকেন।
নহির শাহ বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭৮ সালে আব্দুর রব শাহর শিষ্যত্ব গ্রহণ করি আমি। তারপর থেকে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজির বাণী ভক্তদের মাঝে পৌঁছে দিচ্ছি। সারা দেশেই আমার ভক্ত রয়েছে। দেবোরা ফ্রান্সের মেয়ে, তিনি ভালো মানুষের খোঁজে এসেছিলেন। পরে আমার শিষ্য হয়। দেবোরার মধ্যে জানার প্রবল ইচ্ছা এবং তিনি অনেক কিছু জানে। সাঁইজির বাণী এবং আমাদের জীবনযাপনে দেবোরার মন ভরে যায়। তাই তিনি এখানে থাকতে চেয়েছেন। পরে রাজনের সঙ্গে ধর্মীয় নিয়ম মেনে বিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, সৎ মানুষকে ভজতে হবে, মানুষকে চিনতে হবে। মানুষকে ভজলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। তবে সোনার সোনার মানুষকে ভজে তবেই সোনার মানুষ হওয়া যাবে।
তিনি জানান, দেবোরা খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। বেশ কিছুদিন ধরে মিডিয়ার মানুষের ওপরে তিনি অসন্তোষ। কারণ কয়েকদিন আগে কয়েকজন সাংবাদিক এসে ভুল তথ্য ফেসবুকে দেয়। সেখানে কমেন্ট দেখে অখুশি হয় দেবোরা।
জাত-পাতের বিধান নেই, মানুষই যেখানে প্রাধান্য পায় এমন ‘হেম আশ্রমে’ ভালো মানুষকে ভজে জীবনের বাকিটা সময় বাংলাদেশেই কাটানোর আশা দেবোরা জান্নাতের।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২২
এএটি