ভোলা: ১৩ বছরেও মেয়ে ও নাতিনের কথা ভুলতে পারেননি ভোলার লালমোহন উপজেলার মনোয়ারা বেগম। তিনি এখনও মেয়ের কথা মনে করে কাঁদেন।
২০০৯ সালের এই দিনে (২৭ নভেম্বর) লালমোহনের তেঁতুলিয়া নদীতে ডুবে যায় এমভি কোকো-৪ নামের একটি লঞ্চ। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৮১ জন যাত্রী। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার পেরিয়ে গেছে ১৩টি বছর। তবে এখনও থামেনি স্বজনহারা মানুষের কান্না। সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করে আজও তারা ভাসেন চোখের জলে।
স্বজনহারা মনোয়ারা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ঈদ করতে ঢাকা থেকে লালমোহনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ছিল মেয়েটি, লঞ্চ ডুবিতে মারা যায় মেয়ে ও নাতিন। এভাবে মা-মেয়ের লাশ বয়ে বেড়াতে হবে তা কখনও ভাবিনি। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।
শুধু মনোয়ারা বেগমই নয়, সেই দুর্ঘটনায় তার মতো অনেকেই স্বজন হারিয়েছেন। তাদের হারানোর শোকে কাতর এসব পরিবারগুলো। কোকো-৪ লঞ্চ দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ মা, কেউ সন্তান, কেউবা ভাই-বোন আর পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যাক্তিকে। তাদের হারিয়ে পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে অসহায়।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, দুর্ঘটনার ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি তারা। ক্ষতিপূরণ দেয়নি মালিক পক্ষ। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে কিছু সহায়তা দেয়া হলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ কারও খোঁজ-খবর নেয়নি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও আজও ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে চলছে অধিকাংশ লঞ্চ।
কোকো-৪ দুর্ঘটনায় স্বজনহারা লালমোহন উপজেলার চর ছকিনা গ্রামের আব্দুর রশিদ তার ছেলে নূরে আলম সাগর, সদ্য বিবাহিত পুত্রবধূ ইয়াসমিন, পুত্রের শ্যালিকা হ্যাপি বেগমকে হারিয়েছেন। তিনি ঈদুল আযহা উপলক্ষে সাগর নববধূ ও শ্যালিকাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। সেই দুর্ঘটনায় ৩ জনই মারা যায়।
একই গ্রামের বাকলাই বাড়ির শামসুন নাহার স্বামী, সন্তান, দেবরসহ একই বাড়ির ১৬ জন নিয়ে কোকো লঞ্চে রওনা হয়েছিল বাড়িতে। কিন্তু ঘাটে পৌঁছানোর আগেই ডুবে যায় লঞ্চটি। লঞ্চডুবিতে নিহত হয় তার মেয়ে সুরাইয়া (৭), ভাসুরের মেয়ে কবিতা (৩) ও দেবর সোহাগ (১৩)। সেই থেকেই শামসুন নাহার আদরের মেয়ের শোকে কাতর।
একই এলাকার হাজেরা বেগম হারিয়েছেন তার ছেলে কবিরকে। সুফিয়া হারিয়েছেন তার ছেলে সোহাগকে। সুফিয়া ও হাজেরা তাদের সন্তানদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ। তারা বলেন, ঢাকার থেকে ফেরার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় আমাদের সন্তান মারা গিয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।
সেদিনের সেই মর্মান্তিক ট্রাজেডির কথা মনে করে শোক সাগরে ভাসছে পুরো দ্বীপজেলা, বিশেষ করে লালমোহন উপজেলা। লালমোহন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন বলেন, লঞ্চ কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে এতো মানুষের প্রাণ গেছে। কিন্তু লঞ্চ মালিক পক্ষ কারও খোঁজ-খবর নেয়নি। তাদের কোনো ক্ষতিপূরণও দেয়নি। আমরা ঘটনার বিচার চাই।
লালমোহন থানার ওসি মাহাবুবুর রহমান বলেন, লঞ্চ দুর্ঘটনার ঘটনায় ২০০৯ সালের ৩০ নভেম্বর লালমোহন থানায় ৮ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১১ সালে পুলিশ ওই মামলার চার্জশিট দিয়েছে। মামলাটি এখনও বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।
ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন বলেন, লালমোহনের ইতিহাসে এটি একটি ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনায় ৮১ জন মর্মান্তিক ভাবে মারা যায়। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি দোষী লঞ্চ কর্তৃপক্ষের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকা থেকে ঈদে ঘরমুখো যাত্রী নিয়ে ভোলার লালমোহনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে লঞ্চটি। দিবাগত রাতে লালমোহনের নাজিরপুর ঘাটের কাছে এসে যাত্রী চাপে ডুবে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২২
এসআইএ