বরগুনা: সেবা গ্রহীতাদের জিম্মি করে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে বরগুনা উপ-কর কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। বিনা ফি-তে এই সনদ দেয়ার কথা থাকলেও অসাধু কর্মকর্তারা এ জন্য অর্থ নেন বলেও দাবি ভুক্তভোগীদের।
একাধিক সেবা গ্রহীতার অভিযোগ, ই-টিন (টিআইএন) নিবন্ধন, আয়কর রিটার্ন প্রতিবেদন, টিন (টিআইএন) সনদ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ দাবি করেন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘুষ না দেয়া পর্যন্ত কোনো কাজই হয় না।
এছাড়া কিছু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার ভয় দেখিয়েও ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার সরেজমিনে বরগুনা উপ-কর কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অফিসে ঢোকার মুখে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আয়কর জমা দিতে আসা ব্যক্তিদের কাগজপত্র যাচাই করছেন এক ব্যক্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইনি আয়কর অফিসের নোটিশ সার্ভার মোয়াজ্জেম হোসেন। আয়কর সংক্রান্ত নোটিশ পৌঁছে দেয়াই মোয়াজ্জেম হোসেনের কাজ। কিন্ত তিনি ডেস্কে বসে কাগজপত্রের নানা খুঁত বের করার অযুহাতে ঘুষ দাবি করছেন। আর প্রকাশ্যেই ঘুষ নিচ্ছেন সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে।
প্রতিবেদক কথা বলতে চাইলে ‘স্যারের সাথে কথা বলেন’ বলেই অফিস থেকে সটকে পড়েন মোয়াজ্জেম হোসেন। একই অভিযোগ অফিস সহকারী নিয়াজ মোর্শেদের বিরুদ্ধেও।
আয়কর রিটার্ন দিতে আসা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী সাফায়াত হোসেন বলেন, আমি আয়কর রিটার্ন জমা দিতে আসার পর ডেস্কে বসা ওই ব্যক্তি (মোয়াজ্জেম হোসেন) আমার কাগজপত্র নিয়ে যাচাই বাছাই করেন।
এরপর নানা খুঁত বের করে ঠিক করে দেওয়ার জন্য এক হাজার টাকা দাবি করেন। আমি টাকা দিতে অস্বীকার করি এবং কাগজপত্র ফেরত আনি। তিনি আমাকে অফিস সহকারীর টেবিলে যেতে বলেন, আমি অফিস সহকারী নিয়াজ মোর্শেদের কাছে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গেলে তিনিও একইভাবে খুঁত বের করে কাগজ ফিরিয়ে দেন। পরে সেখানে আয়কর দিতে আসা আরেক ব্যক্তি আমাকে বলেন, ভাই টাকা না দিলে এখানে আপনার কাজ হবে না। বাধ্য হয়ে আমি অফিস সহকারীকে ১০০০ টাকা দিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরগুনা সদরের বেশ কয়েকজন ঠিকাদার জানান, আয়কর জমা দিতে গিয়েও ঘুষ দিতে হয়, আবার সনদ নিতে হলেও তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। টাকা না দিয়ে ট্যাক্স অফিস থেকে কেউই সনদ পায়না।
শহরের চরকলোনী এলাকার বাসিন্দা মারুফ মৃধা বলেন, আয়কর অফিসের কর্মচারীদের ঘুষ নিয়ে সেই টাকা কর কর্মকর্তাসহ অন্যদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। এটা প্রকাশ্যেই ঘটে এবং আপনি অফিসে গেলেই দেখতে পাবেন ফাইলের সঙ্গে টাকা দিলেই কাজ হয়। টাকা না দিলে ওই ফাইলের আর কাজ হয় না।
মিতালী এন্টারপ্রাইজ নামের এক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া ও সনদ পাওয়া বাবদ কর পরিদর্শক আবদুর রহিম আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
একই অভিযোগ সদর সড়কের সাতক্ষীরা দধি ঘরের উত্তম কুমারের। তিনি বলেন, আয়কর জমা দিয়ে সনদ নিতে কর্মকর্তাকে আমি তিন হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছি।
এছাড়াও মিষ্টি ব্যবসায়ী আতাহার মিয়া বলেন, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরে আমি ৫ হাজার টাকা দিয়ে আয়কর সনদ নিয়েছি।
শুধু ব্যবসায়ী নন, সরকারি কর্মকর্তাদেরও জিম্মি করে আয়করের নামে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী (ওজোপাডিকো) বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী অতিব বিশ্বাস বলেন, অনলাইনে আয়কর দেয়ার সুযোগ থাকলেও এখানে সেই সুযোগ নেই। ফলে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গিয়ে হয়রানীর শিকার হতে হয় এবং এক পর্যায়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হতে হয়।
একই অভিযোগ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদেরও।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরগুনার সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আমাদের কাছেও আয়কর অফিসের ঘুষের ব্যাপারে অভিযোগ আসছে। ট্যাক্স দিতে গিয়ে যদি ঘুষ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়, তাহলে আয়কর দেয়ার প্রতি অনিহা সৃষ্টি হবে এবং রাজস্ব আদায় কম হবে। আমরা সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাবো, যাতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আয়কর আদায় ও সনদ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে সহকারী কর কমিশনার মো. কামরুজ্জমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঘুষ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
পরে ঘুষ নেয়ার ছবি ও ভিডিও চিত্র দেখানো হলে তিনি বলেন, আমি আমার অফিস কক্ষেই কাজ করি। বাইরে কারা কি করে সেটা তো দেখিনা। তবে কেউ যদি ঘুষ নিয়ে থাকে, আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২২
এজেডএস/এনএস