ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে অপব্যাখ্যা দূরভিসন্ধিমূলক

ড. সেলিম মাহমুদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩
রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে অপব্যাখ্যা দূরভিসন্ধিমূলক

দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অপব্যাখ্যা শুরু করেছে। তাদের ব্যাখ্যা ও মন্তব্যে এটি প্রতীয়মান, প্রজাতন্ত্রের অভিভাবক রাষ্ট্রপতি এবং দেশের জনগণের পবিত্র ইচ্ছার প্রতিফলন- দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের প্রতি এই গোষ্ঠীর কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই।

 

কোন কোন গণমাধ্যমে এটি বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক কিনা এটি সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। এ তথ্য সঠিক নয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৬ এবং অনুচ্ছেদ ১৪৭ এ এটি সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির পদ কোন লাভজনক পদ নয়। রাষ্ট্রপতির পদ 'লাভজনক' আখ্যা দিয়ে শাহদীন মালিক যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, সেটি হাস্যকর। তিনি বলতে চাচ্ছেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির পদটিকে অলাভজনক পদ হিসেবে বিধান করা হয়েছে কেবলমাত্র সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে। তার বক্তব্য অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির পদটি অলাভজনক হিসেবে গণ্য হবে। ‌‌ তার বক্তব্য মতে, রাষ্ট্রপতির পদটি মূলত 'লাভজনক'।

শাহদীন মালিকের এই বক্তব্যে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ রাষ্ট্রপতির পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তার বক্তব্যে মনে হচ্ছে, সংসদ সদস্য পদের মর্যাদা রাষ্ট্রপতির ওপরে, যে কারণে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনের যোগ্যতার ক্ষেত্রে  রাষ্ট্রপতির পদ ‘লাভজনক’ হওয়া সত্ত্বেও এটিকে ‘অলাভজনক’ বলা হচ্ছে। এই ব্যাখ্যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ এবং ৪৮ এর বিধানের পরিপন্থী। রাষ্ট্রপতির পদ একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে 'অলাভজনক' হিসেবে গণ্য হবে, আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে 'লাভজনক' হিসেবে গণ্য হবে -এ ধরনের ব্যাখ্যা শুধু অসাংবিধানিকই নয়, হাস্যকরও বটে। এ ধরনের ব্যাখ্যা সাংবিধানিক আইন, জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট এবং ইন্টারপ্রিটেশন অফ স্ট্যাটিউটস এর নীতির লঙ্ঘন।  

শাহদীন মালিকের বক্তব্য অনুযায়ী, অনুচ্ছেদ ৬৬ যেহেতু সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান, সেক্ষেত্রে এ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির পদের প্রকৃতি নিয়ে কোন চূড়ান্ত বিধান পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু অনুচ্ছেদ ১৪৭ এ যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ৮টি পদ লাভজনক পদ হিসেবে গণ্য হবে না, সেটি সংবিধানের কোন অংশে অন্তর্ভুক্ত আছে সেটি কি তিনি দেখেছেন? ১৪৭ অনুচ্ছেদ সংবিধানে 'বিবিধ' নামে একাদশ ভাগ এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংবিধানের এই 'একাদশ ভাগ' মূলত রেগুলেটরি এবং ব্যাখ্যামূলক। এই অংশে সংবিধানে উল্লিখিত বিভিন্ন বিধানাবলী এবং শব্দের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের এই অংশে যে বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সেগুলো সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।  

অনুচ্ছেদ ১৪৭ এ রাষ্ট্রপতি সহ ৮টি সাংবিধানিক পদাধিকারীর পারিশ্রমিক বিষয়ে বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই অনুচ্ছেদের উপ অনুচ্ছেদ ১ এ সাংবিধানিক পদাধিকারীর পারিশ্রমিক, বিশেষ অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্ত কিভাবে নির্ধারিত হবে সেটি বলা আছে। উপ অনুচ্ছেদ ২ এ  বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি সহ এ সকল পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ কোন লাভজনক পদ কিংবা বেতনাদিযুক্ত পদ বা মর্যাদায় বহাল থাকতে পারবেন না। এই উপ অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতিসহ সাংবিধানিক এই পদগুলোতে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তিগণ লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হবেন না। অনুচ্ছেদ ১৪৭ এর উপ অনুচ্ছেদ ৪ এ রাষ্ট্রপতিসহ কোন কোন পদ লাভজনক পদ হিসেবে গণ্য হবে না, সে তালিকা দেয়া আছে। এই পদগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা স্পিকার, মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী বা উপ মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, কমপট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, নির্বাচন কমিশনার ও সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য। সংবিধানের এই বিধানটি একটি জেনারেল বা সাধারণ বিধান। এটি সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সংবিধানের এই অংশে অর্থাৎ একাদশ ভাগ এ কিংবা ১৪৭ অনুচ্ছেদের কোথাও এটি উল্লেখ নেই যে, এই বিধানটি কেবলমাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।  

সংবিধানে যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি সহ ৮টি সাংবিধানিক পদ অলাভজনক পদ, সেখানে এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের উদ্দেশ্য কী হতে পারে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।  

তথাকথিত আইনের 'পণ্ডিত'দের জিজ্ঞেস করি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদাধিকারী রাষ্ট্রপতি যিনি মূলত রাষ্ট্রের অভিভাবক, তার পদ যদি লাভজনক পদ হয়, তাহলে অলাভজনক পদ কোনটি?

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৭ এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রথম আলো লিখেছে, ‘কিন্তু শাহদীন মালিক মনে করেন, সংবিধানের ওই বিধানেও রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এ ধরনের বক্তব্য কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বই নয়, এটি নীতি-নৈতিকতারও চরম দেউলিয়াত্বের প্রকাশ। ‌‌ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ করে কারাগারে গিয়েছিলেন, তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করায় এ সকল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মনবেদনা শুরু হয়ে গেছে। বিএনপির রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মতো স্বাধীনতা বিরোধী কাওকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করলে তাদের সেই মনোকষ্ট থাকত না।  

শুধু সাংবিধানিক বিধান নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টও এ বিষয়ে রায় দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করায় এই নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল। রিটে দাবি করা হয়েছিল, প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর কোন লাভজনক পদে নিয়োগ লাভ করা যায় না। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তখন রায় দিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতির পদ কোন লাভজনক পদ নয়।  

লেখক: আইনজ্ঞ এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।