ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কলুষিত হচ্ছে ভাষা ও সাংবাদিকতা

আব্দুর রউফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৩
কলুষিত হচ্ছে ভাষা ও সাংবাদিকতা

বাংলানিউজে একাত্তর ও সময় টিভি’র দুই সংবাদকর্মীর লেখা দু’টো পড়ে খুবই মজা লাগল। এ দু’টি টিভি চ্যানেলের জ্ঞান গরিমা নিয়ে দু`একটি মতামত এর আগে তুলে ধরেছি।

সম্ভবত সেসব লেখা চ্যানেল দু’টির বাঘা  (!) সাংবাদিকরা পড়েন নি। এই দু’টি লেখার পর তাদের সাংবাদিকতা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলতে চাই।

সময় ও একাত্তর। এ দু`টি চ্যানেলের টিকার বা স্ক্রল নিউজ এবং বিভিন্ন নিউজের স্ল্যাগ নেইমে এত বানান ভুল যে, সহজ কথায় বলতে হয় এরা বাংলা ভাষা ও বানানকে ধর্ষণ করছে। ক’টি বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের খপ্পড়ে পড়ে ইজ্জত হারাচ্ছে বাংলা ভাষা। অথচ এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।   এদের বার্তা বিভাগের কারো কারো কাছে এসএমএস করে বানানগুলো ঠিক করার জন্য অনুরোধ করেছি। মাঝে মাঝে ঠিক হয়েছে, আবার মাঝে মাঝে চলছে তো চলছেই। সকাল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত। আগে ফোন করে বা এসএমএস দিয়ে শোধরানোর অনুরোধ করলেও এখন আর তা করি না। কেননা ইদানীং আমাদের মোহনা টিভিতেও অসংখ্য ভুল যাচ্ছে। বাসায় চলে যাওয়ার পরই দেখি টিকারের কি ভয়াবহ অবস্থা। তাই চুপ থাকি। নিজের ঘরই তো ঠিক না।

তুলনামূলকভাবে একাত্তর টিভি`র সাংবাদিকদের বানানজ্ঞান খুবই কম। আমার রিপোর্টারদের কাছে শুনি, এদের সংবাদকর্মীরা নাকি অন্য চ্যানেলের কাউকে পাত্তাই দিতে চায় না। কি অদ্ভুত ধৃষ্টতা। লিখতে পারে না ভাল করে চার লাইন, তারা আবার অন্য সাংবাদিকদের এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে!

আমি আমার রিপোর্টারদের বলে দিয়েছি, এমন পরিস্থিতি আবার হলে, জাস্ট বিনয়ের সঙ্গে একাত্তরের ওই কর্মীকে নিয়ে টিভি’র সামনে বসে যাবে। ওদের চ্যানেল দেখুক পাঁচ মিনিট। ভুলগুলো দেখিয়ে দেবে।

বেশিরভাগ চ্যানেলই বানান ভুলের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে বলা যায়। একদিনের উদাহরণ দিই।

৯ জুন, ২০১৩। আরটিভি।
কার্টুন স্যালাইন, তারেক রহমার, মনস্ত্ত্বাত্ত্বিক, মুলতবি। ছয়টা শব্দের চারটাই ভুল। কার্টন আর কার্টুনের পার্থক্য জানে না। হায় রে সাংবাদিক! রহমানকে লিখেছে রহমার। মনস্ত্ত্বাত্ত্বিক ( আসলে হবে মনস্তাত্ত্বিক) বানানের এমন দশা করেছে যে, এটা পড়লে যে কারো মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা লেজেগোবরে হয়ে যাবে। বানান ভুলে একাত্তরের চেয়েও মাঝে মধ্যে এগিয়ে যায় আরটিভি।

মুলতবি নামে কোন শব্দ নেই অভিধানে। যা আছে তা হলো মুলতুবি (এই বানানটি মোহনা ছাড়া সব টিভিই ভুল লিখেছে। আগামিকাল, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ-এই তিনটি বানানও সব টিভি চ্যানেল অহরহ ভুল লিখছে। সবাই লিখছে আগামীকাল, মন্ত্রীসভা/পরিষদ )।

৯ জুন, ২০১৩। এনটিভি।
আদালত চলাকালীন সময় পর্যন্ত সময় দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। পুরো বাক্যটাই লেজেগোবরে। কালীন বললে আর সময় বলা লাগে না, এটা যদি এনটিভি না জানে তবে বলতে হয়, জাতি বড় দুর্ভাগা। প্রায় ছ’মাস আগে এদের একটা টিকার ছিল এমন: বাস-ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে…..নিহত। বাস-ট্রেনের কোনদিন মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় না। তাহলে হয় ট্রেনকে সড়কে চলতে হবে অথবা বাসকে চলতে হবে রেললাইন ধরে। বলা উচিত বাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে।

৯ জুন, ২০১৩। মোহনা।
তিন চোরসহ ১৫টি গাড়ি উদ্ধার করেছে ডিবি (চোর উদ্ধার হয়েছে নাকি? বলা উচিত তিন চোর আটক, ১৫টি গাড়ি উদ্ধার….।

১০/০৭/১৩ একাত্তর
জীববৈচিত্র্য কে লিখেছে জীববৈচিত্র, বর্জ্যকে লিখেছে বজ্য (রাজশাহীতে পদ্মার পানি দূষিত নিয়ে যে নিউজটা তার স্ল্যাগ নেইম এ)। এইদিন টিকারে দেখলাম কানাডার টরন্টোকে লিখেছে টরেন্টো। …এসবই সংক্ষিপ্ত উদাহরণ। ৯ জুন একাত্তর, বাধা দেওয়াকে লিখেছে বাঁধা। প্রতিরোধ বা ঠেকানো অর্থে হলে বাধা বানানে চন্দ্রবিন্দু হবে না, হবে দড়ি বা অন্য কিছু দিয়ে আটকে রাখার ক্ষেত্রে, এটিও জানে না সাংবাদিকরা।

১০/০৭/১৩ সময়
টিকারে লিখেছে পোর্ট অফ স্পেন। সঠিক উচ্চারণ হবে পোর্ট অ স্পেন। ভারতের উত্তরখন্ড নামে যেটি লেখা হয়েছে তা-ও ভুল। ওটা উত্তরাখন্ড।

১০/০৭/১৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট
স্ল্যাগ নেইম এ সূচককে লিখেছে সূচ (একটি টক শো’র আলোচনার বিষয় । এটা আগের রাত থেকে চলছে। কিছুদিন আগে দেখলাম এদের আলোচনার বিষয়: রাজনীতির গ্যাড়াকলে মাইনকা চিপায় আমরা। কই নিয়ে গেছে সাংবাদিকতাকে এরা। এটা কোন টিভি’র ভাষা হতে পারে?

৯ জুন, ২০১৩। ইটিভি
উত্তরাঞ্চচলে নামে একটা শব্দ দেখলাম টিকারের শুরুতে। অতিরিক্ত একটা চ দিব্যি মাঝখানে ঠাঁই করে নিয়ে শব্দটার অর্থের বারো দু’গুনে ২৪টা বাজিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিকের একটা টিকারে লেখা, আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চেলের…..। খেলার খবরে ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিকে লিখেছে ডার্ক-লুইস। কি হাস্যকর সাংবাদিকতা!

৯ জুন, ২০১৩। বাংলাভিশন।
ওয়ার্ল্ডকে লিখেছে ওর্য়াল্ড। রেফটা হয়ে গেছে য়’র উপর।

এমন অনেক ভুল সব টিভিই কমবেশি করছে। দেখি, শুনি আর কষ্ট পাই। মানুষ শিখবে কার কাছ থেকে। এভাবেই কলুষিত হচ্ছে বাংলা ভাষা আর বিফলে যাচ্ছে ভাষার জন্য প্রাণদানকারী ভাইদের আত্মত্যাগ, কলুষিত হচ্ছে সাংবাদিকতা। একেবারে প্রকাশ্যেই হচ্ছে সব। তবু দেখার বা বলার কেউ নেই। সার্বিক বিচারে অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়া শতগুণ সতর্ক। ভাষাগত খানিকটা সমস্যা থাকলেও বানান নিয়ে একশ’তে একশ।

এদের নিউজ স্ক্রিপটিং ও এডিটিংয়ের মানও স্ট্যান্ডার্ড নয়। এক লাইনে একই শব্দের ব্যবহার হচ্ছে বারবার। শব্দের পুনরাবৃত্তি যে দূষণীয় এবং ভাষার রীতিবিরুদ্ধ, তা বোধকরি এরা জানেই না। নিউজ এডিটরও না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। এরা বলছে, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে, কঠোর আন্দোলনের হুশিঁয়ারি দিয়েছেন বিএনপি`র....(অমুক)....। বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির অমুক আজ একথা বলেন..।

কেমন লাগে শুনতে? মনে হয় কানে পচন ধরেছে। হিসেবটা আসলে সহজ। নিউজ এডিটরের জ্ঞান একেবারে তলানিতে। এই লেখাটায় বলতে হবে, নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে, কঠোর আন্দোলনের হুশিঁয়ারি দিয়েছেন বিএনপি`র....(অমুক)....। নয়াপল্টন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ....(অমুক) আজ এ কথা বলেন..। শুনতে কত ভাল লাগে। অথচ বিশাল বিশাল সাংবাদিক দিয়ে ভর্তি এ দুটি চ্যানেল জানেই-না যে, দ্বিরুক্ত শব্দের ব্যবহার বাক্যে দূষণীয়। দ্বিরুক্ত শব্দ কি এটাই তো বোধকরি অনেকেই জানেন না। জানলে লিখতেন কি?

স্ক্রিপ্ট এডিটিংয়ের এই ধারায় অন্য সবাই-ও এক। একেবারে এ টু জেড বলা যায। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ভুলটি কম করার চেষ্টা করি। মোহনা টেলিভিশনে বলতে গেলে আমি একা নিউজ এডিটর। তাও পুরোপুরি না, জয়েন্ট নিউজ এডিটর। তিন বছর হলো। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব প্রমোশন দেবেন না। যাই হোক, এক সিনিয়র রিপোর্টারকে সম্প্রতি জেএনই হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই হলো মোহনার সম্বল। যেটুকু ভুল আমাদের হয়, তা অনিচ্ছাকৃত। মাত্র দু`জন লোক দিয়ে একটি টিভি চ্যানেলের নিউজ চলছে, এটাই তো নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মত ঘটনা।

আমরা সাংবাদিকরা সব চ্যানেল ফলো করি। কে কি লিখলো, বললো।   সার্বিক বিচারে একাত্তর, সময়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ত তথ্যটা সবার আগে জানাতে পারে, কিন্তু স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা এবং বানানের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে এদের সংবাদকর্মীরা। একেবারে এ টু জেড। এই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে একাত্তর। আমার কথা শুনে যদি আঁতে লাগে, তাদের বলছি, টিভি অন করে বসে থাকেন। প্রতি মুহূর্তে একাত্তরের টিকার, স্ল্যাগ বা অ্যাস্টন প্রমাণ দেবে, আমার দাবি/অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা। তারপরও এদের ভাবটা এমন যে, মুই কি হনু রে! এদের বানান দেখে আমার সবচেয়ে নবীন রিপোর্টারটাও বলে, ভাইয়া আমাদের যে এত বকা দেন, দেখছেন বিখ্যাত চ্যানেল একাত্তরের অবস্থা? শত শত বানান ভুল। আমি উত্তর দিই, ওরা অধম। তাই বলিয়া তুমি উত্তম হইবে না কেন?

আব্দুর রউফ:  যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, মোহনা টেলিভিশন, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৩
জেডএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।