ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

উড়াল পঙ্খীর মতো চলে যাওয়ার একবছর

বিশ্বজিত সাহা, নিউইয়র্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৩
উড়াল পঙ্খীর মতো চলে যাওয়ার একবছর

হুমায়ূন আহমেদ ওইদিনও হাসপাতাল থেকে ফিরেছিলেন নিউইয়র্কের ওজোনপার্কে। ১৯ জুলাই ২০১২।

তবে এদিন আর তাঁর হাতে চকলেট বা খেলনা নেই। প্রতিবারই কেমো থেরাপী নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পথে দুই শিশু সন্তানের জন্য হাসপাতালের গিফট শপ থেকে কোন না কোন চকলেট বা খেলনা তিনি নিয়ে আসতেন। বাসায় পৌছার আগেই খোঁজ নিতেন ওরা কি বাসায় আছে। নাকি অন্য কোথাও রাখা হয়েছে।

বাসায় এসেই প্রথমে দেখতে চাইতেন নিষাদ ও নিনিতকে।   জড়িয়ে ধরতেন দুই শিশু সন্তানকে। কিন্তু সেদিন আর গাড়ীতে উঠে জিজ্ঞেস করা হলো না, নিষাদ, নিনিত কি বাসায় আছে? কেনা হলো না ওদের জন্য কোন চকলেট বা খেলনা? দুটো শিশু যেমন করে বাবার উপস্থিতিতে এবং অনুপস্থিতিতে নিউইয়র্কে ৯মাস সময় অতিক্রম করছে, ওদের কাছে সেরকমই ছিলো দিনটি। অনেক ক্যামেরা, অনেক মানুষ বাড়ীর সামনে, অনেকে ছবি তুলছে। ওরা কি জানে? ওদের জন্মদাতা ওদের ছেড়ে চলে গেছেন অজানা গন্তব্যে, উড়াল পঙ্খীর মতো।

‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে, যা যা তুই উড়াল দিয়া যা’র ¯্রষ্টা নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝ থেকে উড়াল দিয়া চলে গেলেন গত বছর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে। বেলভ্যু হাসপাতালের দশম তলার পশ্চিমদিকের ৪৩তম কক্ষটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেসময় তাঁর পাশে ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ভাই ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ভাতৃবধূ ইয়াসমিন, শ্বাশুড়ী তহুরা আলী, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং প্রকাশক মাযহারুল ইসলাম।

আমি যখন ১টা ৪৭ মিনিটে বেলভ্যু হাসপাতালের দশমতলায় পৌছালাম সব শেষ। ৪৩ নম্বর কক্ষটির সামনে যাবার একটু আগেই নার্স আটকালো। বললো এখন নয় আরো কিছুক্ষণ পরে আসো। প্রায় ৩০ মিনিট পর মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে তাঁর মা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী, মাযহারুল ইসলাম এবং আমি সাদা ধবধবে বিছানায় শায়িত হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গেলাম। চিরনিদ্রায় শায়িত হুমায়ূন আহমেদের কোন কষ্ট নেই, ব্যথা নেই, শরীরের কোন অংশের সাথে অগণিত যন্ত্রপাতির সংযোগ নেই। অন্য এক হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সবচেয়ে পঠিত লেখক নয়, মিসির আলী নয়, হিমু নয় যেন লেখকেরই নতুন আর এক সৃষ্টি ‘সাদা মানুষ’।

দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক দফা অস্ররাপচারের ২৯দিন পর এদিন সকাল থেকে নি¤œ রক্তচাপ-এর ফলে  তাঁকে চিকিৎসকরা বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন। প্রায় তিন সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর অনেকটা নীরবে নিভৃতে কিছু না বলেই চলে গেলেন বাংলা ভাষার কিংবদন্তী এই লেখক।

১২টি কেমো থেরাপী বা প্রথম অস্্েরাপচারের পরও হুমায়ূন আহমেদকে কখনো বিমর্ষ দেখায়নি। সবসময় তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত। হাসপাতালের বিছানায়ও হাসতে হাসতে অবলীলায় বলতেন মৃত্যু নিয়ে রসাত্মবোধক গল্প। সেই মানুষটি কিছুই বলে যেতে পারেন নি, কিছু লিখে যেতে পারেননি। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে মুখে বলতে পারেননি, তবে লিখে জানতে চেয়েছিলেন কবে তাঁর শরীর থেকে এসব যন্ত্রপাতি খোলা হবে। কবে তিনি আরোগ্য লাভ করে বাসায় যাবেন? কখনোই তিনি ভাবতে পারেননি তিনি এভাবে চলে যাবেন। আমার এখনো জ্বল জ্বল করছে প্রথম অস্ত্রোপচারের আগে সার্জেন্ট মিলারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন নিজেই কত শতাংশ নিশ্চয়তা রয়েছে ভালো হবার। তিনি বলেছিলেন আমি অস্ত্রোপচার করলে শতভাগ। উজ্বল হয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের দুচোখ। অনেকটা আনন্দে হাসতে হাসতে মা মাতৃভূমি আর অতি ভালোবাসার নুহাশপল্লী দেখতে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদ দেশ থেকে ফিরে এলেন। কি যে আনন্দ তাঁর চোখে মুখে ছিল তা বলার মত নয়। বললেন, অনেক ভালো লেগেছে দেশে গিয়ে। মা’কে নিয়ে হুমায়ূন ভাইর ভালোবাসার শেষ নেই। মা ছেলের চিকিৎসার জন্য দিয়েছেন সারা জীবনের সঞ্চয়। আর ছেলে ডাক্তার থেকে ছুটি নিয়ে ৩ সপ্তাহের জন্য গেলেন মাকে দেখতে। মার প্রতি হুমায়ূন এর কতো ভালোবাসা তা আজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথাতেই স্পষ্ট। হুমায়ূনভাইর অকাল মৃত্যুর পরপরই বেলভ্যু হাসপাতালে বললেন ‘আমাদের পরিবারকে এবার আরএকটি মৃত্যুর জন্য তৈরি থাকতে হবে। দাদাভাইর মৃত্যু মা মেনে নিতে পারবেন না। ’

দেশ থেকে আসার পর হুমায়ূন ভাইর ভালো লাগার গল্প প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় হতো। বিশেষ করে ভালো ভালো দেশের খাবারের গল্প। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম ফেব্রুয়ারির বইমেলায়, এরপর আবার নিউইয়র্কের বইমেলার জন্য কাজ করতে মার্চে। প্রতিবারই দুসপ্তাহের জন্য ছিলাম। একবারও আমি হুমায়ূন ভাইকে জানাইনি আগে ঢাকায় যাচ্ছি। যেদিন ফ্লাইট ছিল সেদিনই তিনঘন্টা আগে গিয়ে বলেছি, আমি ঢাকায় যাচ্ছি। দুসপ্তাহের জন্য। মাঝখানে ১টি থেরাপীর সময় আমি শুধু ছিলামনা। আর একটি থেরাপীর আগের দিন নিউইয়র্কে পৌছে গেছি। বলে গেছি হুমায়ূন ভাই আমি নেই, রুমা (আমার স্ত্রী রুমা সাহা) আছে। আপনি চিন্তা করবেন না। একটি বিষয়ে গত ৯ মাসে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট থাকলে সে আমাদের গাড়ী দিয়ে হোক আর সাবওয়ে হোক বা অন্য কারো গাড়ীতে যাওয়া হলেও চিকিৎসক দেখার আগে সেখানে বিশ্বজিত হাজির থাকবে। তাঁর এ বিশ্বাস-এর কখনো অমার্যাদা হয়নি। এনিয়ে অনেক সময় অনেক কথাও হয়েছে। দেখা গেছে হুমায়ূন ভাইকে বাসা থেকে ঘুম থেকে উঠিয়েও হাসপাতালে নিতে হয়েছে। অনেক স্মৃতি, অনেক কথা। ১৯৮৭ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘আনন্দপত্র ঈদ সংখ্যায়’ প্রকাশিত উপন্যাস ‘প্রিয়তমেসু’ নিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর সাথে ঘনিষ্ঠতা। ২০১২ সালের ১৯ জুন অপরাহ্নে ২৫ বছরের একটি সম্পর্কের ছেদ, একটি বন্ধনের সমাপন।

আমার এখনো মনে আছে হুমায়ূন ভাইর যখন দ্বিতীয় কেমো থেরাপী চলছে স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে, সেদিন সকালে হুমায়ূন ভাই আমাকে বললেন বিশ্বজিত ক্যান্সারের চিকিৎসা শেষে এবার হার্টেরও চেকআপ করিয়ে যাবো। গতবার ২০০১ সালে তুমি বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলে কিন্তু আমি চিকিৎসা না করে চলে গেছি। এবার চিকিৎসা করিয়ে যাবো। তিন ঘন্টার মতো লাগতো সময়, এরপর পোটেবল থেরাপী সঙ্গে দিয়ে হুমায়ূন ভাইকে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হতো। সেদিনই কেমো নেয়ার ফাঁকে আমি বেলভ্যু হাসপাতালে খোঁজ নিতে যাই। এসে বললাম, কাগজপত্র নিয়ে এসেছি, বাকিগুলো জমা দিয়ে আপনার হাসপাতাল কার্ড করবো। তারপর এক এক করে সব চিকিৎসা শেষ করে ভালো হয়ে দেশে যাবেন।

কোনকিছু অপছন্দ হলে হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি বলে দেন। এর প্রয়োজন নেই বা অন্যকিছু।   কোন এক প্রসঙ্গে এরপরই কেমো থেরাপীর খরচ জানার জন্য একদিন বেলভ্যু হাসপাতালে যাই। পুরো একাউন্ট সেকশন ঘুরেও আমি জানতে পারিনি সিটি হাসপাতালে এর খরচ কতো। দুজন বাঙালী কাজ করেন, এ ডিপার্টমেন্টে। তাঁরা চেষ্টা করেও আমাকে জানাতে পারেনি। আমার শ্বাশুড়ীমার রেফারেন্সে পরিচয় হলো বেলভ্যু হাসপাতালে কর্মরত রনি বড়–য়ার সঙ্গে। এরই মধ্যে হুমায়ূন ভাইরা বেড়াতে যাবেন লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসুর ডেনভারের বাড়ীতে। মহা আয়োজন। যাবার দিন কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে দিয়ে গেলেন, এসে পেলেন হাসপাতালের কার্ড। আমেরিকায় যারা থাকেন, তাদের সকলেই জানেন, কারো অনুপস্থিতিতে কি কখনো তাঁর হাসপাতালের কার্ড হয়। হুমায়ূন আহমেদ-এর বেলায় সেটাই হয়েছিল।   তারপর হুমায়ূন আহমেদ ডেনভার থেকে ফিরে আসলেন। এসেই পেলেন বেলভ্যুর এপয়েন্টমেন্ট। আগে থেকেই আমি এপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছি। এবং অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ জেইনের অধীনে চিকিৎসা শুরু। কাড়ি কাড়ি নগদ টাকা দিয়ে স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়নি। এভাবেই স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতাল থেকে লেখক হুমায়ূন আহমেদ বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়। এর পর হাত পাততে হয়নি কারো কাছে টাকার জন্য। বিক্রি করতে হয়নি নিজের গড়া কোন সম্পত্তি। ঋণ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সবসময় চিন্তিত থাকতেন। পত্রিকায় সাক্ষাৎকারেও বলেছেন চ্যানেল আই-এর ঋণ তিনি দেশে গিয়ে শোধ করে দেবেন। মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালের পাঁচটি থেরাপীর খরচ বহন করার পর চিকিৎসার জন্য আর কোন খরচ বহন করতে হয়নি হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর পরিবারের ইচ্ছে অনুযায়ী মুক্তধারা এবং আমাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে মেডিকেইড কার্ড করিয়ে  বেলভ্যু হাসপাতালে  চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

হুমায়ূন আহমেদ দেশে গেলেন মা ও মাতৃভ’মিকে দেখতে তিন সপ্তাহের জন্য। সার্জেন্ট মিলার যেদিন বললেন ১২ জুন সার্জারীর আগে দেশে যেতে পারবেন। সে কি আনন্দ তাঁর (হুমায়ুন আহমেদ) চোখে-মুখে। হাসপাতাল থেকে জ্যামাইকার বাসভবন পর্যন্ত গাড়ীতে একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করা হয় নুহাশ পল্লীর কেয়ারটেকারকে। আমাকেও বলেছিলেন দেশে যেতে তাঁর সাথে। আবার নিজেই বললেন, তোমাদেরতো বইমেলা। যেতে পারবেনা। গেলে কিন্তু এনজয় করতে। এরপমধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে আসা প্রখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন নিউইয়র্কে এসে মুক্তধারায় হুমায়ূন আহমেদের খোঁজ নেন। যথারীতি হমুায়ূন আহমেদকে জানাই, তিনি বললেন নাসির আলী মামুনকে নিয়ে যেতে। রুমা সাহা নিয়ে যান হুমায়ূন আহমেদের ওজোনপার্কের বাসায়। দেশে যাবেন, খুব ব্যস্ত। তারমধ্যে তাঁর আঁকা জলরংএর ছবিগুলোর ক্যাপশন লিখবেন। রুমা ফ্রেম করে ছবিগুলোও নিয়ে যান তাঁর বাসায়। নাসির আলী মামুন হুমায়ূন আহমেদের আঁকা চিত্রগুলোর পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদেরও অনেক ছবি তুললেন। আমেরিকায় বসবাসকালীন সময় কোন প্রফেশনাল আলোকচিত্রীর তোলা প্রথম ও শেষ তোলা ছবি ছিল সেগুলো। ৯মে ২০১২ এয়ারপোর্টে হুমায়ূন আহমেদকে তুলে দিতে গেলাম আমরা সেদিনও আমাদের সাথে গিয়েছিলেন নাসির আলী মামুন। ছিলেন  গাজী কাশেম ও তাঁর স্ত্রীসহ আরো কয়েকজন। ছিলেন পরিচয় সম্পাদক নাজমুল হাসান এবং বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহেরসহ কয়েকজন সাংবাদিক।   আমরা হুমায়ূন আহমেদকে জেএফকের নীচের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিই। দেশে যাবার পথে দেশ নিয়েও মন্তব্য করলেন সাংবাদিকদের কাছে। তাঁর মধ্যে ছিল বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত আনন্দ। ৩ জুন ২০১২ যেদিন ফিরলেন দেশ থেকে জেএফকে বিমানবন্দরে, সেদিন আমার আর রুমার পৌছাতে কয়েক মিনিট দেরী হয়েছে। ইতিমধ্যে ইমিগ্রেশন ক্রস করে হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর সাথে আসা স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, দুই পুত্র নিষাদ, নিনিত ও প্রকাশক মাযহারুল ইসলাম টার্মিনালে অপেক্ষমান। মেহের আফরোজ শাওন ব্যস্ত হয়ে ড়ৌড়াদৌড়ি করছেন, ব্যাগেজ ডিপার্টমেন্টে। পুত্র নিতিতের স্ট্রলার আসেনি তখনো। আমি দ্রুত টার্মিনালে পৌছাতেই, হুমায়ূন আহমেদের সেই স্বভাবসুলভ হাসি। বললেন, স্ত্রীকে, রাখো স্ট্রলার। আর একটি কিনে নেবো। আমাকে বললেন, গাড়ী কোথায়? আমি বললাম, রুমা সামনেই দাঁড়ানো। আমকরা আর পার্ক করিনি। পুত্র নিনিতকে  (ছোট স্যার) কোলে নিয়ে আমাদের গাড়ীতে উঠলেন। তাঁর আগে সাপ্তাহিক ঠিকানার সভাপতি সাইদ-উর-রব, এনা সম্পাদক লাবলু আনসার, লেখক গাজী কাশেম, আফিয়া ইসলাম, মুনিয়া মাহমুদ ও তাঁর স্বামী মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ,বগুড়া স্কুলে সহপাঠী ফানসু মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না, এটর্ণী সহযোগি রফিক আহমেদ এবং তরঙ্গের স্বত্বাধিকারী রাশেদ আহমেদসহ কয়েকজন বাঙালি এয়ারপোর্টে হুমায়ূন আহমেদকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদ ঠিকই বলেছিলেন, তাঁর সাথে দেশে গেলে অনেক আনন্দ হতো। এসেই বললেন, মিস করলে। প্রতিদিনই ছিল ‘ঈদ’। নুহাশপল্লীতে ছিলে জমপেশ আড্ডা। আমি বললাম, উপায় থাকলে অবশ্যই যেতাম।   তাঁর সাথে ২৫ বছরের বেশি সময়ে যে সময়টুকুই কাটিয়েছি সেসব মুহূর্তই ছিল আনন্দদায়ক। আনন্দ-হৈ হুল্লোড় ভালোবাসতেন তিনি। নিজে স্বল্পভাষী হলেও ঘরোয়া আড্ডাগুলোর মধ্যমণি তিনিই ছিলেন। দেশ থেকে এসে একনাগাড়ে অনেক গল্পই বললেন তিনি। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারোয়ার এর টাকা দেয়ার ঘটনা বর্ণনা থেকে শুরু করে আরো অনেক গল্প। আমি বললাম, আগামিকালই হাসপাতালে যেতে হবে। আগেই অবশ্যই এপয়েন্টমেন্ট করে মেহের আফরোজ শাওনের ইমেইলে জানিয়েছিলাম। বললাম ভালোমতো সার্জারী হয়ে গেলে মাঝখানে ১৫ দিনের বেশি সময় রয়েছে নিউইয়র্কের বইমেলার।

২০১২ সালের ২৯,৩০ জুন ও ১ জুলাই নিউইয়র্কের বইমেলা। বইমেলা নিয়েও ছিল হুমায়ূন আহমেদের অনেক স্বপ্ন। একদিন নিজে থেকেই বললেন বিশ্বজিত এবারের বইমেলায় একটি অনুষ্ঠান হবে ‘শতবর্ষের বাংলা গান’। টপ্পা থেকে শুরু করে হাল আমলের গান পর্যন্ত। প্রতিটি গানের শুরুতে গানটির ইতিহাস বলবেন তিনি (হুমায়ূন আহমেদ)। তখন আলো পড়বে হুমায়ূন ভাইর ওপর। এরপর গান করবেন মেহের আফরোজ শাওন, তখন আলো থাকবে তাঁর ওপর। গান শেষে আলো পড়বে যন্ত্রীদের ওপর। হুমায়ূন আহমেদ-এর স্বপ্নের অনুষ্ঠানটি হলোনা, হলো না তাঁকে সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানটি। হয়েছিলো তাঁর আঁকা জলরং ছবির প্রথম প্রদর্শনী। ২০টি ছবি স্থান পায় এই প্রদর্শনীতে। এটিই হলো হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় প্রথম ও শেষ প্রদর্শনী। সেময় তিনি ছিলেন বেলভ্যু হাসপাতালের সিসিউতে। আসতে পারলেন না হুমায়ূন আহমেদ সেই বইমেলায়।

গত ১৩ নভেম্বর ২০১২ জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারায় অনুষ্ঠিত হয় হুমায়ূন আহমেদের  জীবদ্দশায় অনুষ্ঠিত হয় শেষ জন্মদিন। স্কাইপিতে নিজের টুপি খুলে সবাইকে অবাক করে দেন, তেমনি গ্রহণ করেন জন্মদিনের সিক্ত ভালোবাসা। হুমায়ূন আহমেদ-এর জন্মদিনকে ঘিরে নিউইয়র্কের মুক্তধারা যেভাবে সাজানো হয়েছে তা ছিল দেখার মতো। ৭দিনব্যাপী চলে হুমায়ূন আহমেদ-এর বইয়ের প্রদর্শনী।

যদ্দুর মনে পড়ে ২০০২ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘হুমায়ূন মেলা’ হুমায়ূন আহমেদ-এর উপর সেরা অনুষ্ঠান। সেময়ে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী প্রায়ই আমাকে ঐ অনুষ্ঠানের জন্য অভিনন্দন জানাতেন। দুসপ্তাহের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ-এর শতাধিক বইয়ের প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শন, হুমায়ূন আহমেদ-এর গানের অনুষ্ঠান, হুমায়ূন আহমেদ এর নাটক, হুমায়ূন আহমেদ-এর গল্পবলা নিয়ে অনুষ্ঠিত ঐ ‘হুমায়ূন মেলা’ নিউইয়র্কবাসী তথা বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে অমলিন হয়ে থাকবে।

হুমায়ূন আহমেদ শারীরিকভাবে আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন, হুমায়ূন আহমেদ-এর অনেক স্মৃতি আজ উঁকি মারছে। বলেছেন চিকিৎসা শেষ করে কলকাতায় যাবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  এবারই প্রথম দীর্ঘদিন পর সামারে আমেরিকায় আসেননি, পায়ের ব্যথার কারণে। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে কলকাতায় যাবেন, কলেজ স্ট্রীটের আদর্শ হিন্দু হোটেলের গল্প শুনে বলেছেন, সেই হোটেলে খেতে যাবেন। সেই আদর্শ হিন্দু হোটেলে আমিও কি আর কখনো খেতে যেতে পারবো, আপনাকে ফেলে।

 আর আপনার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে মানুষটি বলেছিলেন শরৎচন্দ্র থেকে আপনি জনপ্রিয়। সেই মানুষটিও চলে গেলেন সেই দেশে। হয়তো আপনাদের মধ্যে দেখাও হয়েছে ইতিমধ্যে। আমরা জানতে পারছিনা, দেখতে পারছিনা।

১৯ জুলাই ২০১২ দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সকাল ১০টায় কথা হলো বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত রণি বড়–য়ার সাথে। বললেন, আগের মত আছেন। নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১২টা থেকে দেশের কয়েকটি সংবাদপত্র অফিস থেকে ফোন এলো। আমেরিকার বিভিন্ন শহরের ফোন। সর্বশেষ বাঙালী সম্পাদক কৌশিক আহমেদ এর ফোন। বললেন, বিশ্বজিত আপনি কি হাসপাতালে? আমি বলছি না, কেন কি হয়েছে। বললেন, হুমায়ূন আহমেদ নেই। তখনি আমি বেলভ্যুতে ছুটলাম। দুপুর পৌনে দুটোনাগাদ বেলভিউতে পৌছালাম। গেটে পাশ নিতে গিয়েই জানতে পারলাম, বাঙালী ভদ্রলোক বললেন হুমায়ূন আহমেদ নেই। এসময় রণি বড়–য়ার ফোন এলো। বললেন, আপনার আশংকাই ঠিক হলো। উপরে উঠলাম। সিসিউতে ঢুকতেই পুরুষদের ওয়ের্টিং রুমে ড. জাফর ইকবাল এবং মাযহারুল ইসলাম এবং যে ছেলেটি রাতে স্যারের রুমে থাকতো তার সাথে দেখা । সকলের চোখেই অশ্রু। তার পরপরই মেহের আফরোজ শাওন, তাঁর মা তহুরা আলী, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন ইকবাল, মাযহারুল ইসলাম এবং আমি এক এক করে কক্ষে থাকা হুমায়ূন আহমেদ-এর কক্ষে তাঁকে দেখতে যাই। ধবধবে সাদা কাপড়ে বাংলা ভাষার নন্দিত লেখক ‘সাদা মানুষ’ হয়ে শুয়ে আছেন। কয়েক সেকেন্ডের বেশি সেখানে আমি দাঁড়াতে পারলাম না।

পাদটীকা: হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে এক বছর হলো। ১৯ জুলাই তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেখানে বাঙালী রয়েছে সেখানেই হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করা হবে। সকলের কাছে আমার প্রস্তাব হুমায়ূন আহমেদের শেষ স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া। হুমায়ূন আহমেদের শেষ ইচ্ছে ছিল: দেশে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। একজন মানুষ দরকার সামনে থেকে যিনি হুমায়ূন আহমেদের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার জন্য সামনে থেকে পথ দেখাবেন। তাঁরএই ইচ্ছে বাস্তবায়নের কথা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বলেছেন গণমাধ্যমে  বিভিন্ন সময়। তিনি যদি এই কাজটি শুরু করেন, কোটি কোটি হুমায়ূন ভক্ত নিশ্চয়ই তাঁর সাথে এগিয়ে আসবেন। আর তখনি লেখকের শেষ ইচ্ছের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানানো হবে। গত বছর তাঁর অকাল প্রয়াণের পর হুমায়ূন আহমেদের নামে একটি সড়কের নামও রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তাঁর সর্বশেষ কি অবস্থা, ১৯ জুলাই ২০১৩ লেখকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ঘ্ষোণা দেবেন এটাই আমাদের কামনা। হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিগাঁথার যুক্তরাষ্ট্র তথা নিউইয়র্ক সবসময় জুড়ে থাকবে। কেননা তাঁর শেষদিনগুলো কেটেছে নিউইয়র্কে। আর একটি আনন্দের ভাগীদারও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালীরা। ২০০২ সালে হুমায়ূন আহমেদের উপস্থিতিতে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় ‘হুমায়ূন মেলা’। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে ‘রবীন্দ্রমেলা’র পর বাংলা ভাষাভাষী কোন লেখক-সাহিত্যিকের জীবদ্দশায় এই ঘটনা ঘটেনি। কাকতালীয়ভাবে নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের বেলায় ঘটেছিল সেই ঘটনা। হুমায়ূন আহমেদ ছাড়াও মুক্তধারা নিউইয়র্ক আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু প্রকৌশলী এফ করিম, চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, তৎকালনীন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্ঠা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, কনসাল জেনারেল রফিক আহমেদ খান, সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, বেলাল বেগ প্রমূখ ব্যক্তিবৃন্দ।

(বিশ্বজিত সাহা: সাংবাদিক ও  ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ গ্রন্থের লেখক)

বাংলাদেশ সময় ২৩২১ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৩
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।