ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

করোনার ভয়াবহতা বিশ্বযুদ্ধের মতো, সাবধানতাই রক্ষাকবচ

ড۔ সেলিম মাহমুদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫০ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২১
করোনার ভয়াবহতা বিশ্বযুদ্ধের মতো, সাবধানতাই রক্ষাকবচ

বৈশ্বিক মহামারি করোনার দ্বিতীয় বছরে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে এই ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এযাবৎ দুই দফায় করোনার দুইটি ঢেউ বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

সম্প্রতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দেশে সংক্রমণের হার দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যা যা করণীয় তার সবটুকুই করেছে এবং করছে। সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ভ্যাক্সিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভ্যাক্সিন রপ্তানিকারক দেশের আভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে তারা ভ্যাক্সিন রপ্তানি স্থগিত করলেও জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কার্যকরী কূটনীতির কারণে অন্যান্য দেশ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভ্যাক্সিন আসতে শুরু করেছে। ভ্যাক্সিন কার্যক্রম আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দেশের সকল মানুষকে দেওয়ার মত পর্যাপ্ত ভ্যাক্সিন পর্যায়ক্রমে চলে আসবে।  

সরকার কর্তৃক দেশে আমদানিকৃত ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। পর্যাপ্ত ভ্যাক্সিন আনার জন্য যা যা করণীয়় তার প্রত্যেকটাই সরকার করছে। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হলে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ইতোমধ্যে কঠোর লকডাউন কার্যকর করেছে। মূলত এদেশের সকল নাগরিকের জীবন রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

শুরু থেকে নানা সরকারি কর্তৃপক্ষ দেশের সকল মানুষকে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য বার বার আহ্বান জানাচ্ছিল। ঢাকার বাইরে দেশের এক বিপুল জনগোষ্ঠী এই সচেতনতামূলক প্রচারণায় একেবারেই কর্ণপাত করেনি। বরং তারা কোভিড-১৯ কে উচ্চবিত্ত বা স্বচ্ছল মানুষদের রোগ বলে বিশ্বাস করেছে। এই জনগোষ্ঠীর এক বড়ো অংশ বলে আসছে, 'গরিবের করোনা হয় না’, ‘গ্রামে তথা ঢাকার বাইরে করোনা নেই’, ইত্যাদি। জনসংখ্যার এই অংশটি বার বার করোনার বিষয়ে নির্লিপ্ত থেকেছে। তারা টিকা নিতে আগ্রহী ছিল না। সারা দেশে ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও দেশের মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে মানুষ একদিকে মাস্ক ব্যবহারসহ করোনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কোন রকমের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেনি। ফলে দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আক্রমণের পর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়েছে। করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের পরও এখনও ঢাকার বাইরে মানুষ করোনা নিয়ে উদাসীন রয়েছে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ সচেতন ও সাবধান না হলে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। মানুষের সচেতনতা ও সাবধানতাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি।  

যে কোনো মহামারির একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে, অধিক সংখ্যক মানুষ একসাথে আক্রান্ত হলে যেকোনো রাষ্ট্রের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। উন্নত রাষ্ট্রেগুলোতেও গত এক বছরে আমরা এটি দেখেছি। তাই দেশের মানুষ সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে একদিকে যেমন করোনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে, অন্যদিকে অধিক সংক্রমনের হার কমিয়ে দেশকে যেকোনো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন একটিই- সেটি হলো মানুষের সহযোগিতা। আপনারা কিছু দিন একটু কষ্ট করুন। আপনারা ঘরে থাকুন, যাদের জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে, তারা মাস্ক ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না। আমরা জানি, মানুষের অনেক কষ্ট হচ্ছে। অনেকেরই রোজগারের পথ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হচ্ছে। এই সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আপনাদের পাশে রয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকতে দেশের একটি মানুষও না খেয়ে মরবেন না। সেই ধরণের ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতা বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সরকারের রয়েছে। তিনি সেই কাজটিই সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, পারদর্শিতা, সাহস, সততা ও মমত্ববোধ নিয়ে করে যাচ্ছেন।  

মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে করোনা মহামারিতে পৃথিবীতে চার মিলিয়ন অর্থাৎ ৪০ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পৃথিবীর মহাপরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষ। ব্রাজিলে সাড়ে পাঁচ লক্ষ, মেক্সিকোতে প্রায় আড়াই লক্ষ, পেরুতে প্রায় দুই লক্ষ, রাশিয়ায় প্রায় দেড় লক্ষ, যুক্তরাজ্যে প্রায় দেড় লক্ষ, ইতালিতে প্রায় দেড় লক্ষ, ফ্রান্সে এক লক্ষের বেশি, স্পেনে প্রায় এক লক্ষ মানুষ ইতোমধ্যে করোনা মহামারিতে মারা গেছে। এই সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে মারা গেছে চার লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলো তাদের লক্ষ লক্ষ নাগরিককে হারিয়েছে মাত্র একবছর সময়ের মধ্যে, এই করোনার ভয়াল ছোবলে। করোনার সেই ভ্যারিয়ান্ট (আলফা ভ্যারিয়ান্ট) একই সময়ে বাংলাদেশেও আঘাত হেনেছিল। কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। কারণ আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১২৪০ জন, যেখানে বিশ্বের জনসংখার ঘনত্বের গড় ৮৫ জন, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জনসংখ্যার ঘনত্বের গড় ৬৭ জন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার ঘনত্বের গড় ৩৮০ জন। উপরে উল্লিখিত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও করোনা মহামারিতে মহা বিপর্যয় হতে পারতো। জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে ঐ সকল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সেই আশঙ্কা আরও বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দক্ষতা, আন্তরিকতা, নানামুখী বাস্তবিক পদক্ষেপ ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে এবং সর্বোপরি আল্লাহর অশেষ রহমতের কারণে করোনা মহামারি বাংলাদেশে এযাবৎ উল্লেখযোগ্য কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি। এই পর্যন্ত করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ হাজার। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার, কষ্টের। তবে সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার এখনও স্থিতিশীল রয়েছে (১.৫%)।

আমাদের একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীর উপর করোনার এই আঘাত পৃথিবীতে ইতোমধ্যে সংঘটিত হওয়া দুটি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। বিশ্বব্যাপি মানুষের প্রাণহানির ঘটনা, মানুষের কষ্ট, আর্থিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষতি বিবেচনায় এটিকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ হিসেবেই চিহ্নিত করা উচিত। আমাদের চিন্তা ও মননে বিষয়টিকে সেভাবেই নিতে হবে। আমরা কিছু দিন ধৈর্য ধারণ করলে, কিছু দিন কষ্ট করলে একটা বড় ধরণের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। আমাদের কিছুদিনের কষ্টের মাধ্যমে আমরা বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারি। অথচ এই পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন যুদ্ধসহ নানা সংকটে বছরের পর বছর অনেক কষ্ট করেছে। অনেক অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছে। মাসের পর মাস অনাহার, অর্ধাহারে জীবন কাটিয়েছে। যুদ্ধ কিংবা মানবাধিকার লংঘনের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গণহত্যারও শিকার হয়েছে। নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সেই মানুষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। নিজেদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।  

এই করোনার আক্রমণ থেকে নিজে, নিজের পরিবার ও দেশের জনগণকে বাঁচানোর জন্য আমরা কিছুদিন কষ্ট করতে পারি না? একটু ধৈর্য ধারণ করতে পারি না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মোট ২১৯৪ দিন অর্থাৎ ছয় বছর ধরে চলেছিল। গণহত্যা, বোমা হামলা, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে খাদ্য সংকট ও রোগাক্রান্ত হয়ে মোট ৭৫ মিলিয়ন অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলেছিল চার বছরের বেশি সময় ধরে। এই যুদ্ধে দুই কোটি পঁচিশ লক্ষ মানুষ সরাসরি যুদ্ধের কারণে মারা গিয়েছিলো। এই যুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা উদ্ভুত মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু'র তিনটি ওয়েভে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলো, যাদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে ছিল প্রায় অর্ধেক মানুষ। এই স্প্যানিশ ফ্লু'তে শুধু ভারতেই প্রায় দেড় কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলো। এই ফ্লু'তে যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।  

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা একটি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেই যুদ্ধের আগে এক দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব তিনি দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। কয়েক লক্ষ নারীসহ অসংখ্য মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এক কোটি মানুষ জীবন রক্ষার্থে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। জাতির পিতার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেয়েছি। তারই কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুদ্ধে জয়ী হয়ে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। আজ করোনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষে এই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়- পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই এটি সম্ভব নয়। করোনা সম্পর্কিত জনগণের সতর্কতা, সাবধানতা এবং এবিষয়ে সরকারের নির্দেশ মেনে চলাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড়ো সহযোগিতা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করবই ইনশাল্লাহ।  

লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।