আপনি নির্বিবাদী, কাজপাগল মানুষ। কারো সাতে পাঁচে নেই।
পাঠক, এটি কল্পিত কোনো গল্প নয়। এরকম পরিস্থিতি হতে পারে আপনার জীবনেও। প্রমাণ-টমান দরকার নেই, মামলা করেই অর্ধেক বিচার করা সম্ভব এখন এই দেশে। ফেসবুক, ইউটিউব পেলো ভিউ, লাইকের খাদ্য। কীভাবে? দেখুন না, গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ৮ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের মামলাটি। মুনিয়া মারা গেছে ১৯ এপ্রিল। প্রথম মুনিয়ার বোন মামলা করলেন, আত্মহত্যা প্ররোচনার। এই মামলায় তিনি একজনকে অভিযুক্ত করলেন। তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হলো হৈ চৈ, হুলস্থল। সবাই যেন বিচারক। পারলে এক্ষুণি বসুন্ধরার এমডিকে ফাঁসি দেয়। একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন যারা মিডিয়া ট্রায়াল করছে এরা তো সবাই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার গোষ্ঠী। মুহূর্তে বুঝবেন মুনিয়ার বিচার নয়, এরা সরকারকে বিপদে ফেলতে চায়। একটি কিশোরীর লাশকে ঘিরে শুরু হলো ষড়যন্ত্রের পৈশাচিক নৃত্য। শেষ পর্যন্ত ঐ মামলা নিষ্পত্তি হলো। কিন্তু তিনটা মাস একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কুৎসিত নোংরা খেলা হলো তার বিচার কে করবে?
নাটকের শেষ এখানেই নয়। ৬ সেপ্টেম্বর মুনিয়ার বোন একই বিষয়ে ধর্ষণ এবং হত্যা মামলা করলেন। আত্মহত্যা হয়ে গেলো হত্যাকাণ্ড। এবার আসামি করা হলো ৮ জনকে। এদের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানও আছেন। মুনিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী, এটা খুঁজতে খুঁজতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিচার করা হচ্ছে। আবার সেই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার। আশ্চর্য এবং দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই মামলায় ৫ জন নারীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধর্ষণের মামলায় নারী আসামি। কি অদ্ভুত!
বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক মামলা করতেই পারেন। কিন্তু আদালতকে অবশ্যই একটি মামলা তদন্তে দেওয়ার আগে তার মেরিট দেখতে হবে। যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘প্রাইমা ফেসিয়া কেস। ’ আদালত যদি কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই যে কোনো মামলা আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়, তাহলে প্রতিহিংসা এবং ব্লাকমেইলিংয়ের এক সর্বনাশের খেলা শুরু হবে। কালকে আপনার ওপর রাগ করে, কোটে গিয়ে আপনার বিরুদ্ধে ঠুকে দেবে মামলা। এরপর মিডিয়া ট্রায়ালে আপনি বিচার তদন্তের আগেই ক্ষত বিক্ষত হবেন। লংঘিত হবে সংবিধান। আমাদের সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ’ আদালত হয়তো স্রেফ আনুষ্ঠানিকতার জন্যই মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আদালতের আনুষ্ঠানিকতা কিছু মানুষকে যে কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারে তা কি কেউ ভেবেছে? আদালতের আনুষ্ঠানিকতা একটি গোষ্ঠীর কাাছে চরিত্র হননের অস্ত্র তুলে দেওয়া। এই মামলার সূত্র ধরে কাউকে বিপদে ফেলতে একটা মামলা করে, সোশাল মিডিয়াতে গল্প ছড়ালেই হলো। বিচার লাগবে না। এখন এই মামলার উদাহরণ টেনে যদি, জামায়াত-যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী বিভিন্ন কথিত গুমের অভিযোগকে হত্যাকাণ্ড বলে মামলা করে, আর এগুলো যদি তথাকথিত তদন্তে পাঠানো নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন কি সরকার একটা অস্বস্তিতে পড়বে না? এই মামলার দেখানো পথে যদি দেশের ১০টি প্রধান শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী মামলা করে তাদের হয়রানি করে, তাহলে কি অর্থনীতির চাকা থমকে যাবে না?
সবচেয়ে বড় কথা এই মামলা কি মিডিয়া ট্রায়ালের (নাকি সোশাল মিডিয়া) পথ উন্মুক্ত করে দিলো না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী যার বিরুদ্ধে অসহায় বলে নিজেই কবুল করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২১
নিউজ ডেস্ক