ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখটি প্রতি বছর গভীরভাবে স্মরণ করি। দিবসটি বাঙালি জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ দিন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি তাঁর শত্রুভাবাপন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে দ্বিধা করেননি। কোনো সংলাপ বয়কট বা বর্জনের রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। পাকিস্তান সরকার তাঁকে অব্যাহতভাবে নাজেহাল করেছে, কিন্তু তারপরও তাঁরা আলোচনার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তাতে যোগ দিয়েছেন এবং নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বঙ্গবন্ধু যে লিখিত জবানবন্দি দেন, তার সঙ্গে শুধু নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ তুলনীয়।
আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুব সরকারের পতনের লক্ষ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ছাত্র-যুব-শ্রমিক –পেশাজীবীদের দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। ওই মামলা থেকে তিনি আদালতের রায়ে মুক্তি পাননি, বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় বন্ধুকে শত্রুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনে গণ–অভ্যুত্থান ঘটিয়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২২ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাঁকে রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা দেয়। সেখানে তাঁকে যে অভিধায় সম্বোধন করা হয়, আজ তা তাঁর নামের অংশ: বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ বছরের বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সারাৎসার অংশ তাঁর আমাদের বাঁচার দাবী ৬–দফা কর্মসূচি লেখাটি। প্রথম মুদ্রণের পর স্বাধীনতার আগেও এটি অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে। ছয় দফার সংক্ষিপ্ত আকারের পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। তবে প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকাটির বক্তব্য মূল্যবান নানা কারণে।
জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয় এবং নির্বিঘ্নে আবার ক্ষমতায় আরোহণের এক ঘৃণ্য মনোবাসনা চরিতার্থে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয়।
১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় এবং পূর্ব ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন শুরু হয় ২০ জানুয়ারি শহিদ আসাদের রক্তাক্ত জামা হাতে নিয়ে যে শপথ- ২৪ জানুয়ারি মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীরের রক্তের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ সৃষ্টি করেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে আবার সান্ধ্য আইন জারি করলে যথারীতি ছাত্ররা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসে পল্টনের জনসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান করে। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্য দিয়ে শপথ দিবসের স্লোগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করবো’।
আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই যে, প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাব, সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।
শুরুতেই বলেছি ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সে দিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমুদ্রের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম। এর আগে এত বড় জনসভা দেখিনি।
তিনি জানান, যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সেই নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো। লাখ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু। ’
বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে- ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ। একেকটি আন্দোলনের একেক রকম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ছিল। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিচারের কাজ চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে ’৬৮-এর ১৯ জুন বিচারের কাজ শুরু হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর জন্য আইয়ুব খান পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ‘আইয়ুব খান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন।
সেই বইয়ে উল্লেখ আছে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ’৬৯-এর গণআন্দোলনের শহিদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ সেই ষাড়যান্ত্রিক প্রচেষ্টাকে সমাধিস্থ করে এবং আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-আনোয়ারা-ড. শামসুজ্জোহার জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন সফল হয়। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভায় দম্ভোক্তি করে আইয়ুব খান বলেছিলেন তিনি আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন।
অথচ ১৭ জানুয়ারি আন্দোলন শুরু হলো, ২০ জানুয়ারি আসাদ শহিদ হলেন, ২৪ জানুয়ারি শহিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং সেই আইয়ুব খান একদিন পরই বলেছেন ‘আমি আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না। ’ একটি আন্দোলন সাত দিনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়-ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে, ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে! এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের এ স্বাধীন বাংলাদেশ, যাদের রক্ত ঋণে গোটা জাতি ঋণী, তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ভোলায় নিজ গ্রামে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছি।
সেই জাদুঘরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শহিদ সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের স্মৃতি, মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, শহিদদের স্মৃতিচিহ্ন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতার দুর্লভ সব আলোকচিত্র সেখানে স্থান পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য মহান নেতা। তার কোনো তুলনা হয় না।
তিনি জন্মেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি যদি না জন্মাতেন আমরা আজও পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। সেই মহান নেতা তার জীবদ্দশায় সব সময় এ দিনগুলোর কথা সংবাদপত্রে বাণী, বিবৃতি দিয়ে শহিদদের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতেন। কেননা, তিনি জানতেন ৬ দফা আন্দোলন না হলে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হতো না; ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না হলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না; বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্ত না হলে ’৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানে আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারতাম না; আর পাকিস্তানে যদি আমরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারতাম, তাহলে ৯ মাস যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজের যে ভূমিকা তা গৌরবোজ্জ্বল। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন।
যতদিন বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ এবং বাঙালি থাকবে ততদিন শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়ার ইতিহাস বেঁচে থাকবে সব বাঙালির হৃদয়ে।
(তথ্য সংগ্রহ: আওয়ামী বর্ষিয়ান নেতা, সংসদ সদস্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভাপতি তোফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার এবং ইতিহাসের পাতা থেকে। )
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট, পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ, প্রকল্প পরিচালক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর