ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

অমোঘ পাড়ের চিঠি

মাহমুদা আফরোজ লাকী, পিপিএম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০২২
অমোঘ পাড়ের চিঠি

লক্ষী হাসুপা,
জানি, আজ তোমার মন ভালো নেই। সারাদিনের ব্যস্ততা সেরে কখন তুমি রাতের আকাশে আমায় খুঁজবে, আমি তারই অপেক্ষায় ছিলাম।

এই সেই কালো রাত। পঁচাত্তরে আগস্ট মাসের এই রাতেই আমাকে, আব্বা ও মাকে নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে আসতে হলো।

হাসুপা, তোমার বারান্দার সামনে সবুজ লনটা দেখে মনে পড়ে আমাদের ধানমন্ডি বত্রিশের বাড়িটার সামনে একটা ছোট্ট সবুজ ঘাসে ভরা লন ছিল। তুমি আমাকে সেই লনে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিলে। যেদিন প্রথম তোমার হাত ছেড়ে আমি একা একা হাঁটতে লাগলাম, তোমার সে-কী আনন্দ! চিৎকার করে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করলে ‘রাসেল সোনা হাঁটতে শিখে গেছে, রাসেল সোনা হাঁটতে শিখে গেছে!’ আজ-ও কোনো ছোট শিশুকে ওভাবে হাঁটতে দেখলে তোমার গালে চিক চিক করে ওঠে লোনা জল। আর চোখে ভেসে ওঠে রাসেল সোনার এলামেলো পায়ে হাঁটার দৃশ্য!

আমি বুঝতে পারি হাসুপা, তোমার ভীষণ আফসোস হয়, কেন যে সেবার জুলাই মাসে আমাকে তুমি তোমার সঙ্গে করে জার্মানি নিয়ে গেলে না ! কিন্তু‘ আমার তখন জন্ডিস হয়েছিল। মা আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে দিল না। আমারও একদম ইচ্ছে হলো না মা আর আব্বাকে রেখে তোমাদের সঙ্গে যেতে। আব্বাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। মনে আছে সেই একাত্তরে স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে বাবা বিছনায় বসে ছোট্ট আমাকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিল। আর তখনই পাক হানাদার বাহিনী আমাদের বাসা ঘেরাও করে আব্বাকে নিয়ে যায়। আমাদের বন্দি করে রাখে ছোট্ট একটা একতলা বাসায়। আব্বার জন্য আমার তখন কী যে কষ্ট হতো! 
এখানে আমি মা আর আব্বার সঙ্গে খুব ভালো আছি। সবুজ লনে সারাদিন খেলা করি।

হাসুপা, একাত্তরে সেই ডিসেম্বরে যখন এয়ার রেইড শুরু হলো, ছোট্ট জয় তখন গোলার শব্দে ঘুমাতে পারত না, কেঁপে কেঁপে উঠত। তখন মাত্র তো চার মাস বয়স ছিল ওর। আমি তখন সব সময় পকেটে তুলা রাখতাম। সাইরেন বাজালেই জয়ের কানে তুলা গুঁজে দিতাম। অথচ ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট ভয়ংকর গ্রেনেড হামলায় তুমি আহত হলে, তোমার কানে আঘাত পেলে! আমি পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালাম তোমার সুস্থতার জন্য। তখনো আমি তোমার পাশেই ছিলাম, হাসুপা। আর আব্বা তোমার মাথার ওপরে হাত রেখে আশীর্বাদ করতে থাকে সারাক্ষণ। যখনই বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে যায়, আব্বা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,‘ জয় বাংলার জয়, আমার সোনার বাংলার জয়। ’

হাসুপা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তার দোসররা বুঝতে পেরেছিল আমি বেঁচে থাকলে আমি আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতাম আর বাংলার মাটি থেকে হায়েনার দলকে চিরতরে তাড়িয়ে দিয়ে শত্রুমুক্ত রাখতাম আমাদের সোনার বাংলাদেশকে। তাই সেই কালো রাতে তারা আমার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। ধাতব বুলেটের আঘাতে কী যে কষ্ট হয়েছিল, হাসুপা!  বারবার বলেছিলাম, ‘মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে নিয়ে চলো। ’ ওরা তাই আমাকে মায়ের সঙ্গেই পাঠিয়ে দিল এখানে। তাতে অবশ্য আমার একটুও দুঃখ নেই। আব্বার স্বপ্ন আজ তুমি পূরণ করে চলেছ। আজ বাংলার ক্ষেতগুলো ভরে গেছে সোনালি ধানে। চারদিকে শুধু সোনা আর সোনা। আর সেই সোনালি ক্ষেত থেকে উঠে আসছে উন্নয়নের জোয়ার, ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে, দেশে থেকে বিদেশে। লাল-সবুজের পতাকা হাতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দৃপ্ত শপথে লাখ-লাখ রাসেল দৌড়ে চলেছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পথে। শত শত রাসেল আজ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলেছে, দেশ থেকে বিদেশে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।  
ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত হয়ে, নারী নেতৃত্বে, কৃষি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে এক রোল মডেল। গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার বৃদ্ধি, সব সামাজিক সূচকে তুমি এগিয়ে নিয়েছো আব্বার, আমার, আমাদের সবার সোনার বাংলাকে। এজন্যই সেদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছিল তোমাকে।  
হাসুপা, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার তুমি সুদক্ষ কারিগর। তুমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছো, তাদের বসবাসের ঘর দিয়েছো। যেদিন ব্রিটিশ মিডিয়া তোমায় ‘মাদার অব হিউম্যাননিটি’ বলে তোমার বড় বড় ছবি ছাপালো, সেদিন আনন্দে মা আচঁল দিয়ে চোখ মুছেছিল।  
তুমি মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছো, বঙ্গবন্ধু ওয়ান স্যাটেলাইট যা আমাদের দেশের জন্য যেমন সম্মানজনক তেমনি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।

সেবছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে উন্নত দেশগুলো যখন মৃত্যোপত্যকায় পরিণত হলো, তুমি ঠিক সামলে নিলে আমাদের ছোট্ট দেশটাকে। ডাক্তার, পুলিশ, প্রশাসনসহ মাঠ পর্যায়ে ফ্রান্ট লাইনারদের প্রতিনিয়ত সাহস দিযে গেছো তুমি। কাজকর্ম বন্ধ থাকায় না খেয়ে মরতে দাওনি কাউকে। নানাভাবে রিলিফ দিয়ে, ওষুধ দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে, পাশে থেকে বাড়িয়ে দিয়েছো মানুষের মনোবল ও আয়ু।  
তুমি দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটিয়েছো স্বপ্নের ‘সেতু পদ্মা’ তৈরি করে।  
তুমি তৈরি করছো দেশের প্রথম টানেল, বঙ্গবন্ধু টানেল। কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের মানুষকে শুধু সংযুক্ত করবে না এই টানেল, সেইসব এলাকায় নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে এই টানেল, খুলে দেবে চট্টগ্রামের বাণিজ্য ও ব্যবসার নতুন দিগন্ত। তোমার নেতৃত্ব আর পৃষ্ঠপোষকতায় কত নতুন নতুন স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে দেশের যুব ও তরুণ সমাজের।  
বাংলাদেশের কতশত রাসেলরা আজ খেলায়, শিক্ষায় দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। আব্বা এসব দেখে আর আমাকে বলে, ‘দেখ, দেখ, আমার আরেক রাসেল বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা হাতে দেখাচ্ছে। বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে আমার বাঙালি জাতির নাম’।  
আব্বা ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিল, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে রাখতে পারবা না। ’ সত্যিই আজ আব্বা দেখছে.....। জঙ্গিবাদ, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, অতিমারি কোনো অশুভ শক্তির কাছেই মাথা নত করবে না বাংলাদেশ। আর সব চেয়ে ভালো লাগে যখন দেখি সবার সামনে দাঁড়িয়ে আব্বার স্বপ্ন চোখে আমার স্নেহময়ী হাসুপা।

হাসুপা, তুমি এগিয়ে যাও, এগিয়ে নাও আমাদের প্রিয় সোনার বাংলাকে। এগিয়ে নিয়ে যাও দেশকে ‘নীল কন্ঠ পাখি’ হয়ে, আব্বার স্বপ্ন সারথী হয়ে গড়ে তোলো তোমার সোনার বাংলা।  
জয় বাংলা।  

‘ইতি
‘তোমার ছোট্ট রাসেল সোনা’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত স্মৃতিচারণামূলক রচনা ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ অবলম্বনে-

 

লেখা- মাহমুদা আফরোজ লাকী, পিপিএম
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২২
এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।