ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

রাজনীতি

কোনো ইস্যুতেই হালে পানি পাচ্ছে না বিএনপি

আসাদ জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১০
কোনো ইস্যুতেই হালে পানি পাচ্ছে না বিএনপি

ঢাকা: কোনো ইস্যুতেই হালে পানি পাচ্ছে না বিএনপি। তাই বারবার কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিলেও কোনো কর্মসূচিতেই বেকায়দায় ফেলতে পারছে না সরকারকে।

এমনকি হঠাৎ পাওয়া ইস্যুগুলোও একের পর এক হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপির ইস্যুতে বিএনপিকেই বধ করছে ক্ষমতাসীনরা।

সর্বশেষ, মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় দীর্ঘ সময় ঘিরে রাখলেও ওটা বিএনপিরই সাজানো নাটক বলে দাবি করছে সরকার পক্ষ।

দলীয় সূত্রমতে, সরকারবিরোধী আন্দোলন জমানোর জন্য গত দু’বছরে বিএনপির তৈরি অধিকাংশ ইস্যু কোনো না কোনোভাবে হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়ায় দলের হাইকমান্ডও চিন্তিত হয়ে উঠেছে। আবার ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ না থাকায় দলের প্রগতিশীল ও সমমনা রাজনৈতিক দলের পরামর্শে অনেক ইস্যু থেকে সরে আসতে হয়েছে দলটিকে।

উপরন্তু বিএনপির আন্দোলনে সহায়ক হতে পারতো এমন অনেক ইস্যু বুমেরাং হয়ে  বেকায়দায় ফেলছে বিএনপিকেই।

দৃষ্টান্ত হিসেবে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। ওইদিন সন্ধ্যায় বিস্ফোরণ ঘটে বিএনপি চেয়ারপারসন তার কার্যালয়ে থাকাকালেই। ওই বিস্ফোরণে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আক্তার হামিদ পবন আহতও হন।

পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত।

এরপর এ ইস্যুতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ১৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে বিএনপি। সমাবেশ পরবর্তী মিছিলের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে পুলিশের। ওই সংঘর্ষে এক পথচারী নিহত হন। আহত হন বিএনপির ১২ নেতকর্মী। গ্রেপ্তার হন বেশ কয়েকজন।

দলীয় সূত্রমতে, ইস্যুটিকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার হঠাৎ পাওয়া সুযোগ হিসেবেই নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ব্যর্থ হয় কাজে লাগাতে। তারা দুর্বার আন্দোলন শুরুর আগেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। উল্টো অভিযোগের তীর বেঁধে মহাসচিবপুত্র পবনের ওপর।   গ্রেপ্তার করা হয় তার বন্ধু গোলাম সাব্বির শোভন, প্রদীপ সাহা ও সুলতান হাসানকে। পলাতক থাকেন ছাত্রদল নেতা ওমর ফারুক।

বর্তমানে আক্তার হামিদ পবন অন্তবর্তীকালীন জামিনে থাকলেও মাঠে মারা যায় বিএনপির আন্দোলন পরিকল্পনা।

এরপর ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ভোলা-৩ উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে বড় ধরনের আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। ৩ মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচিও পালন করে তারা।

কিন্তু মুক্তাঙ্গন থেকে শুরু হওয়া এ পদযাত্রা কোনো প্রকার পুলিশি বা রাজনৈতিক বাধা ছাড়াই বাংলামটরে এসে শেষ হয়। তাই পুলিশি বাধাকে ইস্যু করে আন্দোলন গড়ার সুযোগ হাতছাড়া হয় বিএনপির।

এরপর ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে প্রধান বিরোধী দল চট্টগ্রাম থেকেই কঠোর আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা নিয়েছিল বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র। নির্বাচনের পর বিএনপি মহাসচিব কারচুপির অভিযোগও তুলে বসেছিলেন। কিন্তু ওই নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর ব্যাপক বিজয় তাদের সম্ভাব্য ইস্যুর ইতি ঘটায়।

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জে খালেদা জিয়ার সমাবেশে কাছে ট্রেন দুর্ঘটনায় ৭ কর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে সৃষ্ট ইস্যুটিও পুরোপুরি বিএনপির অনুকুলে যায়নি। ১১ অক্টোবরের ওই ঘটনায় উল্টো বিএনপিকেই বিপাকে পড়তে হয়েছে।  

ট্রেনে কাটা পড়ে ৭ কর্মীর মৃত্যুকে ইস্যু করে মাঠ গরম করার আগেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় সরকার।

ট্রেনে অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের মামলায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা গ্রেপ্তারও হয়েছেন। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরো শত শত নেতাকর্মী। তাই ওই ইস্যুতে আন্দোলন জমানোর পরিবর্তে এখন পিঠ বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের।  

সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়ার ইস্যুটিও কাজে লাগাতে পারছে না বিএনপি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার ইস্যুতে বিএনপি দুর্বার আন্দোলনের কথা চিন্তা করলেও ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ না থাকায় দলের প্রগতিশীল অংশ এ ইস্যুতে আন্দোলনে না যাওয়ার পরমর্শ দিয়েছে।

এছাড়া সংবিধান সংশোধন, জাতীয় শিক্ষানীতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিভিন্ন স্থাপনা থেকে জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলা, বিএনপির সিনিয়র ভাইসচেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা, তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ইত্যাদি ঘটনাকেও আন্দোলনের জোরালো ইস্যু বানাতে পারেনি বিএনপি।

তবে তৈরি ইস্যু কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করতে নারাজ বিএনপি নেতারা।

দলটির স্থায়ী কমিটি সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিএনপি জনগণের রাজনীতি করে। আন্দোলনের জন্য ইস্যু সৃষ্টি করে না। আর ইস্যু সৃষ্টির কোনো কৌশলও অবলম্বন করে না। ’

ইস্যু হাতছাড়া হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো ইস্যু আমাদের হাতছাড়া হয়নি। আন্দোলন ঠেকাতে সরকার আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলা দিচ্ছে, হামলা চালাচ্ছে তার খেসারত তাদের দিতে হবে। ’

দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘সৃষ্ট ইস্যুগুলো কাজে লাগাতে পারছি না, সেটি ঠিক নয়। আমরা আস্তে আস্তে জনগণকে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া ইস্যু তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ইস্যু আরও আসবে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে অবশ্যই সরকারকে জনস্বার্থে কাজ করতে বাধ্য করব। ’

এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই আন্দোলনের নতুন ইস্যু পেয়েছে বিএনপি। মঙ্গলবার মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দীর্ঘ সময় ঘিরে রাখে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়। এ সময় সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন খালেদা।

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা বিুব্ধ হয়ে ওঠেন।   দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকার বিরোধী মিছিল-শ্লোগান শুরু হয়ে যায় রাতেই। বুধবারও দিনভর এ নিয়ে উত্তপ্ত থাকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল।

বিএনপির পক্ষ থেকে এ ঘটনাকে সরকারের বাড়াবাড়ি ও ফ্যাসিবাদি আচরণের প্রকাশ বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বিএনপির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, বিএনপির কার্যালয় পুলিশ ঘেরাও করেনি। ওটা বিএনপিরই সাজানো নাটক।

তাই সর্বশেষ এ ইস্যুটিও বিএনপির হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে খালেদার কার্যালয় ঘেরাও ইস্যুতে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন জমাতে চাইছে বলেই আভাস মিলেছে দলীয় সূত্রে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।