বৃহস্পতিবার (০৮ জুন) দুপুরে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। মওদুদের পক্ষে তিনিসহ এ জে মোহাম্মদ আলী, মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা উপস্থিত ছিলেন।
প্রথমে শুনানি শুরু করেন এজে মোহাম্মদ আলী। কিছুক্ষণ শুনানির পর মুলতবি করেন হাইকোর্ট।
সকালে নিজেই রিট আবেদনটি উপস্থাপন করেন মওদুদ আহমদ।
মওদুদের চেম্বারের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসানুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, রিট আবেদনে দু’টি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাড়িটির নকশায় যেন কোনো ধরনের পরিবর্তন না আনা হয়। অন্যটিতে সেখানে তার থাকার অধিকার ফিরে পেতে নির্দেশনা চেয়েছেন মওদুদ আহমদ।
শুনানিতে এজে মোহাম্মাদ আলী বলেন, ‘কোনো নোটিশ না দিয়েই উচ্ছেদ করা হয়েছে। এটি আইনের লঙ্ঘন’।
আদালত বলেন, ‘নোটিশ ছাড়াইতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছেন। তাই জরুরি কিছু না। আজ (বৃহস্পতিবার) শেষ দিন। অনেক মামলা আছে। তাই আপনারা ছুটির পর আসেন অথবা অবকাশকালীন বেঞ্চে যান’।
এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাদের বের করে দিয়েছে ঠিক। কিন্তু সেটি বেআইনিভাবে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সরকার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করলো। একজন নাগরিককে (মওদুদ) নোটিশ ছাড়াই রাতারাতি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। তার তো আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আছে’।
তিনি বলেন, ‘আদালত হস্তক্ষেপ না করলে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেবে’।
আদালত বলেন, ‘ওরা যেমন নোটিশ ছাড়াই উচ্ছেদ করলো। তেমনি আপনারাও এ বাড়ির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় ছাড়াই রিট করলেন’।
এ পর্যায়ে আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ দেন।
কিন্তু এজে মোহাম্মদ আলী তখনও দাঁড়িয়ে শুনানি করতে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘রাজউকের বা সরকারের অধিকার নেই নোটিশ ছাড়া উচ্ছেদের। আইন অনুসারে উচ্ছেদ হয়নি’।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘ওই বাড়িতে কিছুই নেই। এসি পর্যন্ত খোলা হয়েছে। সব বের করে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আপিল বিভাগের রায়ের পর উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তিনি (মওদুদ) নিম্ন আদালতে মামলা (স্যুট) দাখিল করেছেন। ওই মামলা বিচারাধীন অবস্থায় হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারেন না’।
জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘আমিও সোজা কথা বলছি, ছুটির পর আসুন। না হয় অবকাশকালীন বেঞ্চে যান। কারণ, বিস্তারিত শুনানির প্রয়োজন আছে। সময় লাগবে’।
এ সময় কনিষ্ঠ বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে শুধু রুল জারি করলে কোনো অসুবিধা আছে কি-না?
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ মামলায় বিস্তারিত শোনার দরকার আছে। তাই এ মুহূর্তে রুল জারি করা ঠিক হবে না’।
এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘রুল জারির পর বিস্তারিত শুনানি হতে পারে’।
এ পর্যায়ে কনিষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘রুল দিচ্ছি। এতে আপনার অসুবিধা থাকার কথা নয়’।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে এ আদেশের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘রুল জারি করতে পারেন না। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নিজেই বলেছেন যে, বিস্তারিত শুনানির জন্য সময়ের প্রয়োজন। সেখানে আপনি রুল জারি করতে পারেন না’।
এরপর মওদুদ আহমদের পক্ষে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘সরকার কোনো নোটিশ না দিয়েই বেআইনিভাবে উচ্ছেদ করেছে। এ অবস্থায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন আবেদনকারী। এখানে প্রতিকার না পেলে কোথায় যাবেন?’
এ পর্যায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আগামী ২ জুলাই আদালত খোলার দিন পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে আদেশ দেন।
আদালত থেকে বের হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে যে, জাল-জালিয়াতি করে আম মোক্তারনামা তৈরি করা হয়েছে। মৃত অষ্ট্রিয়ান নাগরিক ইনজে প্লাজকে জীবিত দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। এরপর আপিল বিভাগ তার আবেদন খারিজ করে দিয়ে রায় দিয়েছেন। রিভিউ আবেদনের রায়ও হয়েছে। এ অবস্থায় তিনি নিম্ন আদালতে মামলা করেছেন। সেখানে মামলা বিচারাধীন। এ অবস্থায় হাইকোর্টে রিট করেছেন, যা সঠিক হয়নি’।
‘মূলত জাল-জালিয়াতির অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতেই এটি করছেন তিনি (মওদুদ)। অন্য কোনো দেশ হলে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগণের কাছে জোড় হাতে ক্ষমা চেয়ে বাড়িটি ছেড়ে দিতেন’।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর এ সংক্রান্ত মামলায় বাড়িটিতে মওদুদ ও তার ভাই মনজুর আহমদের মালিকানা অবৈধ বলে সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায় দেওয়ার তিনদিন পর বুধবার (০৭ জুন) রাজধানীর গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ১৫৯ নম্বর বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে মওদুদের দখলমুক্ত করে বাড়িটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সিলগালা করে রেখেছে সংস্থাটি।
ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে মালিকানা পান তিনি। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।
ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আম মোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়া হয়েছে অভিযোগ এনে দুদক মামলা করলে চার বছর আগে শুরু হয় আইনি লড়াই।
মওদুদ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলেও রায় তার বিপক্ষে যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করলেও গত রোববার (০৪ জুন) তা খারিজ হয়ে যায়। ফলে ৩৬ বছর ধরে সপরিবারে বসবাস করে আসা বাড়িটি ছাড়া মওদুদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে।
চূড়ান্ত রায়ে হেরে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেছিলেন, ‘দেশে কি আইন নেই? আমি আইনের আশ্রয় নেবো। আদালতের আশ্রয় নেবো’।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৭
ইএস/এএসআর