গত ২৫শে মার্চ ২০১২ যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনে তহবিল তসরুফ সংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষ্যে অ্যাসোসিয়েশনের ইন্টেরিম কমিটি এক সাধারণ সভার আয়োজন করে। সভায় ইন্টেরিম কমিটির মাহতাব মিয়া ও সুফি মিয়াসহ প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন।
তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, বিগত কমিটি অ্যাসোসিয়েশনের যাবতীয় ফান্ডই শুধু আত্মসাত করে নাই, অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ সেন্টারের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। এ ঘটনা গোটা বহু-সংস্কৃতির প্রবাসী সোসাইটিতে বাংলাদেশিদের মুখ অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রলয়ংকরী সিডরে আক্রান্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য ফান্ড গঠণের লক্ষ্যে নিউক্যাসল সিটি কাউন্সিল, লর্ড মেয়র অব নিউক্যাসল স্পন্সর এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে যে চ্যারিট্যাবল ফান্ড বা টাকা উত্তোলন করা হয়, তার পুরোটাই বিগত কমিটি অতি সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে। ওই ফান্ডের একটি কানাকড়িও সিডর ফান্ডের কোথাও কিংবা কোনো এনজিওর মাধ্যমে দেওয়া হয় নাই।
শুধু তাই নয়, তদন্তে দেখা যায়- নিউক্যাসল বাংলাদেশি সেন্টারে লাশ ধোয়ার স্থান নির্মাণ তহবিলের পূরো টাকাও আত্মসাত করেছে।
বিগত কমিটি এখানেই থেমে থাকেনি। নিউক্যাসল বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন সোশ্যাল ইনক্লোশান ফান্ড থেকে এমপ্লয়ি বেতন এবং খরচ বাবদ যে ৫১ হাজার পাউন্ড অনুদান লাভ করে সেখান থেকে টাকা মেরেও ফেলে সেন্টারকে দেনার দায়ে আবদ্ধ করে ফেলে।
এদিকে, রিপোর্ট প্রকাশকালীন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাবেক সম্পাদক (পরে সভাপতি) শাহ ফজলুল করিম আবারো নতুন করে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে উপস্থিতদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে ইন্টেরিম কমিটির পক্ষে মাহতাব মিয়া মাইক কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আজ রিপোর্ট প্রকাশের জন্য সভা, কারো এই রিপোর্ট বুঝতে অসুবিধা হলে প্রশ্ন করতে পারেন, কমিটি যথাসাধ্য চেষ্টা করবে বুঝিয়ে দিতে বা ব্যাখ্যা করতে। কারণ বিগত কমিটির সব বক্তব্যই এই রিপোর্ট প্রণয়নের আগে নেওয়া হয়েছে পরিপূর্ণভাবে।
পরবর্তীতে যোগাযোগ করা হলে শাহ ফজলুল করিম এই রিপোর্টের ব্যাপারে তেমন কোনো দ্বিমত পোষণ করেন নাই। তিনি বলেন, ‘নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের চেয়ে কমিউনিটির স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে, যাতে যোগ্য নের্তৃত্ব নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে উঠে। ’
মাহতাব মিয়ার নের্তৃত্বাধীন ইন্টেরিম কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
সিডর সাইক্লোন রিলিফ ফান্ড, ডিসিসড (লাশ) ওয়াশ ফেসিলিটি, পে-ইয়ি ডেবট, চেইঞ্জেস দ্য নেইম অব এনবিএ, ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টস, এমপ্লই-কমিউনিটি ওয়ার্কার,০৬)আন অথরাইজড চেইঞ্জেস টু দ্য কন্সটিটিউশন।
তাদের তদন্তের সীমা ছিলো ২০০৫ সাল থেকে জুলাই ২০১১ পর্যন্ত সময়কাল।
তদন্তকালে কমিটি বিগত কমিটির যেসব মোস্ট সিনিয়র পদস্থ কর্মকর্তা এবং মেম্বারদের সাথে কথা বলেন, ইন্টারভিউ নেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আহমেদ আনহার জামান, আফসার সফজ্জুল খান, শাহ ফজলুল করিম, শাহ জাহান, হাবিব কোরেশী, হামিদ রহিম, দীপু আহাদ প্রমুখ।
তদন্ত চলাকালীন এবং বিগত কমিটির মেম্বারদের ইন্টারভিউ নেয়াকালীন তারা কমিটির কাছে কোনো প্রকার ডকুমেন্টস, এভিডেন্স, মিনিটস, কিংবা কোনো অ্যাকাউন্টিবিলিটি প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিডর এর টাকা, লাশ ধোয়ার ফান্ড কোথায় কী হলো তাও পর্যন্ত বলতে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দেন। চেয়ারম্যান-ট্রেজারার কেউই প্রকৃত ফান্ড এর কোনও খবরই জানাতে পারেন নাই।
ইনকোয়ারি কমিটি দেখতে পায়, সিডর এর জন্য ২৬ হাজার পাউন্ড ফান্ড রেইজের একটি টাকাও সিডর ফান্ডে দেওয়া হয় নাই, যদিও সর্বমোট কতো টাকা ফান্ড রেইজ হয়েছিলো কিংবা ২৬ হাজার পাউন্ডের বাইরে আর কোনো টাকার হদিস ইনকোয়ারি কমিটি পায় নাই।
ধারণা করা হচ্ছে, সিডর এর জন্য ধারণার চাইতেও বেশি ফান্ড কালেকশন হয়েছিলো। কারণ সিডর ফান্ড রেইজিং এর জন্য নিউক্যাসল সিটি কাউন্সিলের লর্ডমেয়রের সাথে যৌথভাবে স্পন্সর হয়েছিলো এইচ বি ক্লার্ক এবং এলউড পোল্ট্রি ফার্মের মতো নামকরা ব্রিটিশ অর্থল্পগ্নীকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ইনকোয়ারি কমিটি আরো দেখতে পায় যে, লাশ ধোয়ার স্থান নির্মাণের জন্য বাংলাদেশিদের কাছ থেকে সংগৃহীত ৯ হাজার পাউন্ডের কোনো হদিসই নেই, এ ব্যাপারেও কমিটি কোনও প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়।
কমিটি আরো দেখতে পায় যে, সোশ্যাল ফান্ড ইনক্লোশান থেকে আগত মঞ্জুরীর ৫১ হাজার পাউন্ডও কমিটি তসরুফ করেছে।
এই রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত বিগত কমিটির প্রভাবশালী আরো এক নেতা আনহার আহমেদ জামানের সাথে বারবার যোগাযোগ করেও জবাব পাওয়া যায় নাই। অবশেষে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে তার বক্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আনহার জামানের কাছ থেকে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায় নাই।
একটি সূত্র অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে উল্লেখ করেন, রিপোর্ট প্রকাশ হবে শুনে সে বাংলাদেশে চলে গেছে।
অপরদিকে, নিউক্যাসল সিটি কাউন্সিল এবং চ্যারিটি কমিশনের বক্তব্য যথাসময়ে পাওয়া যায় নাই। এখন দেখার বিষয় চ্যারিটি কমিশন কী ভূমিকা পালন করে এই রকম ভয়বহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
তবে দসরুফ হওয়াসিডরের এই তহবিল উদ্ধারে এবং এর যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দূতাবাস ইন্টেরিম কমিটির সাথে যৌথভাবে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৭ ঘণ্টা, ০৩ এপ্রিল, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর