বলা হচ্ছে, শ্যুটার তাগুচি আকির কথা। ভাগ্যদশায় হুইল চেয়ার সঙ্গী হলেও নিজেকে মোটেও ‘ব্যতিক্রমী’ মনে করেন না জাপানের প্যারা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সম্প্রতি দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন জাপান অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক-২০২০ এর শুভেচ্ছা দূত তাগুচি। এর মাঝে একদিন অংশ নেন রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত একক বক্তব্য অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে দোভাষীর সাহায্যে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অংশ নেন তাগুচি।
তাগুচি বলেন, আগে আমি অন্যদের মতোই চলাফেরা করতে পারতাম। স্বাভাবিক জীবন ছিল আমার। তবে ২৫ বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে আঘাত পাই যা আমার মেরুদণ্ডে রক্ত চলাচলেও স্থায়ী বাধা তৈরি করে। তখন থেকেই আমি আর চলাফেরা করতে পারি না। হুইল চেয়ারই আমার সঙ্গী।
সেখান থেকে শ্যুটার হলেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তাগুচি আকি বলেন, শ্যুটার হবো এমন কোন ভাবনা আগে থেকে আমার মাঝে ছিল না। তবে দুর্ঘটনার কিছু সময় পর থেকে নিজের কিছু করার ইচ্ছে হচ্ছিল। এমন কিছু যা স্বাভাবিক মানুষেরাও করতে পারে। আমি থেমে থাকতে চাইনি। তখন একজনের হাত ধরেই মূলত শ্যুটিংয়ে আসা। আর একবার যখন শুরু করলাম তারপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি।
প্যারা অলিম্পিকে তিন বার জাপানের প্রতিনিধিত্ব করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক এই নারী শ্যুটার বলেন, যতবারই অংশ নিয়েছি নিজের মাঝে একধরনের নতুন শক্তি অনুভব করেছি। সবসময় আমি স্বপ্ন দেখি সমবেত সমাজের যেখানে আমাদেরকে আলাদা করে দেখা হবে না। আমরাও স্বাভাবিক মানুষদের মতো। আমরাও সমাজে একই রকম অবদান রাখতে পারি। সেই অনুভূতি আরও দৃঢ হয়েছে যখন ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে শ্যুটিং এ ফাইনাল রাউণ্ডে উঠি। সেবার চ্যাম্পিয়নের থেকে ১ পয়েন্ট কম নিয়ে ৫ম স্থান অর্জন করলেও নিজের কাছে সত্যিকার অর্থে চ্যাম্পিয়ান ছিলাম।
বাংলাদেশে আসা হলো কিভাবে এবং বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা কেমন; এমন প্রশ্নের জবাবে তাগুচি আকি বলেন, আমি জাপান প্যারা অলিম্পিকের দূত হিসেবে কাজ করছি। তারই অংশ হিসেবে লাওস সফরে ছিলাম। আয়োজকেরা আমাকে বললেন ঢাকায় আসার কথা। জাপান ও বাংলাদেশ দুই বন্ধু রাষ্ট্র। এখানকার প্যারা এথলেটদের উৎসাহিত করতেই ঢাকায় আসা হয় আমার। ঢাকায় এসে সত্যিই খুব ভাল লাগছে। এখানে অনেকের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে। ব্র্যাকের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুরা পড়ালেখা করে। আমি আসব শুনে তারা আমার জন্য একটি মালা বানিয়ে দিয়েছে। এটা খুবই ভাল লেগেছে। এখানে অনেক সম্ভাবনাময়ী অ্যাথলেট আছে। তাদেরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মতবিনিময় পর্ব কেমন ছিল? তাগুচি বলেন, এখানকার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। প্যারা অলিম্পিক নিয়ে তারা খুবই ‘সিরিয়াস’। আগের থেকেও বেশি। তারা এই বিষয়ে আরও জোর দিতে চায়।
সবশেষে সবাইকে নিজ নিজ জীবনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র জানিয়ে বললেন, আমাদের মাঝে একটা প্রবণতা হচ্ছে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখার। আমাদের কী নেই, কী করতে পারি না সেটিকেই আমরা বড় করে দেখি। কিন্তু আমরা দেখতে পারি আমাদের কী আছে। মানুষ হিসেবে আমাদের আর কী করার আছে সেটা দেখতে হবে। অর্থ্যাৎ ‘নেগেটিভিটি’কে ‘পজেটিভিটি’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। একই সাথে অন্যদের উচিত না আমাদের মতো মানুষদের ভিন্ন চোখে দেখার। আমাদেরকেও স্বাভাবিক মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবেই দেখা হোক। আমি চাই না আমি হুইলচেয়ারে দেখেই কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসুক। হ্যাঁ, কিছু কাজ তো আমি পারি না। তার জন্য অন্যের সাহায্য লাগেই। তবে আগে নিজে চেষ্টা করে দেখতেই। আর আমি যেন চেষ্টা করতে পারি সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে আমাদের আশেপাশের মানুষদেরই। এমনটা করা গেলে, আমরা সবাই সমাজের জন্য অবদান রাখতে পারব।
আরও পড়ুন>> ‘ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর অগ্রগতি থামানো যাবে না’
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২০
এসএইচএস/এজে