ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

শাকিব ছাড়া গতি নেই!

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৫
শাকিব ছাড়া গতি নেই! শাকিব খান / ছবি: নূর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ভিডিও দুটি একসঙ্গে দেখলাম। কোনোটাই এখনও আমজনতা দেখেনি।

কারণ এগুলো উন্মুক্ত হবে আরও কিছুদিন পর। একটি গান। অন্যটি ট্রেলার। দুটোই ‘সম্রাট’ ছবির। এগুলোতে শাকিব খানকে দেখে অবাক হলাম! তাকে এভাবে আগে কখনও দেখিনি। চুলের সাজ, পোশাক, শারীরিক ভঙ্গি, মুখের নাড়াচাড়া, তাকানো- সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন। দেখেই মনে হচ্ছে, ‘সম্রাট’ হতে যাচ্ছে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি। মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের আইফোন সিক্সে ‘সম্রাট’-এর শিরোনাম-গানের ভিডিও আর ছবিটির ট্রেলার দেখছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। একবার শেষ হতেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, আরেকবার দেখান!

শাকিবের সঙ্গে রাজের কার্যালয়েই বেশিরভাগ সময় দেখা হয়েছে। ওপার বাংলা এমনকি বলিউডের কয়েকজন তারকার চেয়েও তিনি সুন্দর! এটা অনেকের মুখে শুনেছি। সামনে থেকে দেখলে তা নিয়ে সন্দেহ থাকবে না কারও। শাকিব হলেন ভক্তদের কাছে রোমাঞ্চকর আর স্বপ্নের ব্যাপার। শাকিব মানেই একক আধিপত্য, রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা। জীবনে কতো কতো সফল ছবিই না উপহার দিলেন! এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক বছর ধরেই তার লম্বা-চওড়া চাহিদা। পারিশ্রমিক নেন অভাবনীয়। শাকিবের ওপর আস্থা রেখে এখনও প্রযোজকরা দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বাজি ধরেন। বিজ্ঞাপনেও তিনি মানেই হুলস্থুল, এলাহী কান্ড!

এবারের ঈদে মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবির তালিকাটা দেখুন। হাতেগোনা চারটি ছবি আসছে। এর মধ্যেও দুটোই শাকিবের। তার উপস্থিতির সুবাদেই শাহীন সুমনের ‘লাভ ম্যারেজ’ আর এসএ হক অলিকের ‘আরও ভালোবাসবো তোমায়’ ছবি দুটির প্রতি বুকিং এজেন্টদের আগ্রহ বেশি। আগে এমনও ঈদ গেছে, শাকিবের চার-পাঁচটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এ নিয়েও কথা বলেছি। তার কাছ থেকে উত্তর এলো, ‘বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছি। কারণ ঈদে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের সরব উপস্থিতি থাকে। ঈদে বাড়তি বিনোদন পেতে হলমুখী হন তারা। ফলে ঈদে দর্শকের কাছাকাছি বেশি থাকার সুযোগ হয় আমার। ’

বিনোদনশিল্পের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র। আর এ দেশে সেলুলয়েডের প্রাণ এখন শাকিবই। ব্যবসাসফল ছবির অক্সিজেন পাওয়া যায় তার বাগানে! চলচ্চিত্র বাজারে আশার ফুল শাকিবই। তাকে ঘিরে এমন একটা হাইপ তৈরি হয়েছে যে, হিট ছবি দেওয়া যেন তার জন্য কোনো ব্যাপার না! নির্মাতারা তাকে নিলেই মনে করেন, আর কিছু লাগবে না! শাকিব থাকলেই হলো! এটা কি চাপ হিসেবে কাজ করে না? শাকিব কি উত্তর দিলেন দেখুন- ‘একজন শিল্পীর সব ছবিই ব্যবসাসফল হবে, এ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। ‘হলিউড, বলিউডেও কিন্তু সব ছবির ব্যবসা হয় না। ভালো ছবি দেখতে দর্শক আসবেই। আর এ জন্য দরকার বড় বাজেট, ভালো গল্প, উন্নত কারিগরি দিক। আমার ছবি প্রত্যাশিত ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলে ধরে নেবেন, ওগুলো যথাযথভাবে তৈরি করা হয়নি। এ কারণে এখন যাচাই-বাছাই করছি। ’ যোগ করে বললেন, ‘জোড়াতালি দেওয়া গল্প নিয়ে কাজ করলে লাভ নেই। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে এসব দেখলে নিজেরই মেজাজ খারাপ হয়। ছবি হয়তো আমার নামে চলে, কিন্তু নিজের ভালো লাগার জায়গা খুঁজে পাই না। আট-দশ দিনে ছবির শুটিং শেষ করে ফেলা, যেনতেনভাবে ছবি মুক্তি দেওয়া- এভাবে ভালো কাজ হতে পারে না। ’

শাকিব মনে করেন, টাকা হলেই ছবি হয় না, এজন্য দরকার মেধা। প্রয়োজন ভালো গল্প, পরিচালক ও দক্ষ টিম। ‘টাকা-পয়সা আমাকে ওপরওয়ালা যথেষ্ট দিয়েছেন। এখন শুধু টাকার জন্য অভিনয় করি না। অনুরোধের ঢেঁকিও গিলি না। একটি ছবির ব্যর্থতার দায়ভার আমার ওপরই এসে পড়ে। তাই এর ভালোমন্দ নিজেই দেখার চেষ্টা করি। মানের কথা ভেবে হয়তো মাঝে মধ্যে নির্মাতাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করি। গানের শুটিং এফডিসির ফ্লোরে কৃত্রিম সেট বানিয়ে কিংবা এখানে-সেখানে করতে বাধা দিয়ে সুন্দর লোকেশনে যাওয়ার জন্য চাপ দেই। ’

‘হিরো দ্য সুপারস্টার’ দিয়ে শাকিব যখন প্রযোজনায় এলেন, তখনও মান নিয়ে আপস করেননি। অবশ্য তখন বলাবলি হতে লাগলো তার পড়ন্তবেলা চলে এসেছে। বাজারদর আগের মতো নেই। এখন নাকি আগের মতো ব্যবসাসফল হয় না তার ছবি। এ কারণেই প্রযোজনায় এসেছেন। কিন্তু হিসাব-নিকাষ বলছে শাকিব ছাড়া গতি নেই! তা যে যতোই বড়াই করেন! তাকে যারা পছন্দ করেন, তারা তো মানেনই। যারা পছন্দ করেন না, তারাও এটাকে দিবালোকের মতো সত্যি জানেন। শাকিবের সাম্রাজ্যটা এক লহমায় বিলীন হয়ে যাবে না- এ নিয়ে বাজি ধরলে জিতবেন যে কেউ!

শাকিব ছাড়া দেশে চিত্রনায়কের তালিকায় আছেন আরিফিন শুভ, বাপ্পি, ইমন, নিরব, সায়মন, জায়েদ খান প্রমুখ। মোটা দাগে মনে হতে পারে বিকল্প আছে। কিন্তু তাদের কাউকে দিয়ে কোনো নির্মাতা টেবিল কালেকশনের ‘নিশ্চয়তা’ শব্দটির ছায়া দেখেন না। গালভরা কিছু কথাই শুধু হয়। শাকিবই পারেন সেই স্বস্তি দিতে। এটা সর্বজনস্বীকৃত। আদতে শাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউই নন। তার ভাষ্য, ‘সবসময় নিজেকেই নিজের প্রতিযোগী ভেবেছি। কখনও কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করিনি। দর্শকদের ভালোবাসায় এখনও কাজ করেতে পারছি। ভালো কাজের নেশাটা মাথায় নিয়েই এগোচ্ছি। ’

এখন পরিচালক বাছাই করে কাজ হাতে নিচ্ছেন শাকিব। ‘সম্রাট’-এর জন্য রাজের ওপর আস্থা রেখেছেন। ‘মেন্টাল’-এ তিনি সুযোগ দিয়েছেন শামীম আহমেদ রনিকে। ‘সত্তা’য় আরেক তরুণ হাসিবুর রেজা কল্লোলের সঙ্গে প্রথমবার কাজ করছেন। ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী টু’ ছবিতে পছন্দ করেছেন তরুণ চিত্রনাট্যকার রুম্মান রশীদ খানের কাজ। শাকিবের সাফ কথা, ‘যারা ভালো ছবি উপহার দেবে, তাদের কাজই তো করা উচিত, নাকি? গল্পে নতুনত্ব পেলে, সম্ভাবনাময় মনে হলে এখন থেকে নতুনদের প্রাধান্য দেবো। ’

শাকিবের অর্জনের ফিরিস্তিতে অসংখ্য ছবি তো আছেই, আছে ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ (২০১০) আর ‘খোদার পরে মা’ (২০১২) ছবির জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয়, অভাবনীয় পারিশ্রমিক নেওয়া, ৬০০টিরও বেশি প্রেক্ষাগৃহে চলা ছবির তারকা, একই ঈদে সর্বাধিক চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়া- অভিনয়ের পনেরো বছরেরও বেশি সময়ে এমন একাধিক রেকর্ড লিখেছেন। ভক্তরা ভালোবেসে নামের আগে ‘কিং খান’, ‘যুবরাজ’, ‘নাম্বার ওয়ান’ বিশেষণগুলো ব্যবহার করেন। কিন্তু তিনি কোনো বিশেষণে বিশ্বাসী নন বলে জানিয়ে রাখলেন।

সারাবছরই অনেক চাপ থাকে শাকিবের ওপর। শুটিং, ডাবিং, শিডিউল বন্টনের ওপর ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। এসব কারণে সব সামলাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। একজন মানুষ আর কতোই বা পারেন! একের পর এক ইনিংসে ব্যাট করলে ব্যাটসম্যানরা ক্লান্ত হন। শাকিবের মধ্যেও টানা কাজের ক্লান্তি আসে। তখন শরীর মহাশয়কে নিয়ে পারেন না। সেজন্য যেতে হয় হাসপাতালেও। কিছুদিন আগেও দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। তবে এখন তিনি ফিট। সবার অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ছবিপ্রতি বিশাল পারিশ্রমিক না পারতে চান না। অবশ্য তার বিরুদ্ধে শুটিং স্পটে দেরি করে আসার অভিযোগ শোনা যায়। ‘সম্রাট’-এর বেলায়ও দেখলাম ব্যাপারটা। কিন্তু রাজ জানালেন, দেরি করে এলেও ঠিকই গভীর রাত অবধি কাজ করে দেন শাকিব। এ প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, ‘আট ঘণ্টার বেশি কাজ করা ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের এখানে ১২ ঘণ্টার শিডিউল নেওয়া হয়। এটা পাল্টানো দরকার। আমরাও তো মানুষ। কাজের পরিধি প্রতিদিন আট ঘণ্টার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলে কাজও ভালো হয়। ’

অভিনয়ের পাশাপাশি নির্বাচনেও সফল হয়েছেন শাকিব। ফলে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি পদের দায়িত্বও আছে। দেশে ভারতীয় ছবি আমদানির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন। তার মতে, ‘ভারতীয় ছবি এলে আমাদের শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। ছবি আমদানির চেয়ে সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নত করা আর সিনেপ্লেক্স বানানোর দিকে জোর দেওয়া উচিত সবার। জেলা শহরের প্রেক্ষাগৃহগুলো মধ্যবিত্ত পরিবারের অনুপযোগী। ভারতীয় ছবি এলেই যে তারা প্রেক্ষাগৃহে যাবেন, এটা ভাবা ভুল হবে। সিনেমা হল উন্নত হলে ও সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়লে দর্শক বাংলা ছবিই দেখবে। দর্শককে প্রেক্ষাগৃহমুখী করাই আমাদের সবার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ’

শাকিব কী জিনিস, কেমন ধাতুতে বানানো; তা নির্মাতারা জানেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ হাল না ছাড়া। তিনি আগাগোড়া হার না-মানা ছেলে। শাকিব আশাবাদী মানুষ। ‘আমি মনে করি, আমাদের ছবির মান ভালো করা প্রয়োজন। সেজন্য দরকার উন্নত কারিগরি-সুবিধা। দেখবেন ধীরে ধীরে আমাদের ছবির অবস্থা বদলাবে। বদলাতেই হবে। আমরাই বদলাবো। ’

বাংলাদেশ সময় : ২১১০ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ