তিনশ’ ফুট রাস্তা ধরে, কুড়িল থেকে আধঘণ্টা গাড়ি চালালে কাঞ্চন ব্রিজ। প্রশস্ত, বুক উঁচু ব্রিজটার একটু আগে, হাতের বাঁ-দিকে যে রাস্তাটা নেমে গেছে, ওটা ধরে, চোখ-মুখ শক্ত করে আরও মিনিট দশেক বসে থাকতে হবে।
চেহারাভর্তি, মাথাভর্তি ধূলো নিয়ে পৌঁছানো গেলো গোবিন্দপুরে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায়। গ্রামের নাম যিনি জানালেন তার হাতে কাস্তে। বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। ক্ষেত থেকে উঠে এসেছেন শুটিং দেখবেন বলে। পাশেই শোনা গেলো আরেকজন মোবাইল ফোনে খুব উচ্ছ্বসিত, ‘কলকাতা বাংলা আছে না? ছবিতে... মীরাক্কেল করে? রনি দা? তার শুটিং। ’ স্কুল ছুটি হয়েছে মাত্র। একদল ছাত্রী পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো। শুটিং দেখে, জটলা হয়ে, লাজুক চোখমুখ নিয়ে তারা হয়ে গেলো ভিড়!
কড়া রোদের মধ্যে রজতাভ দত্ত দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে, একটু দূরে, চার-পাঁচটা গাড়ির সারি। মুখোমুখি আশীষ বিদ্যার্থী। ওপারের এই দু’জনের পাশে টাইগার রবি ও অমিত হাসান। মারধরের দৃশ্য। শেষ করে রজতাভ ও আশীষ রিফ্লেক্টরের ছায়ায় গিয়ে বসলেন। সেলফি শিকারীরাও কাছে চলে এলো এক-দু’জন করে। আর যাদের ‘সাহস একটু কম’, তারা খানিকটা দূরত্ব রেখে ঘিরে দাঁড়ালো।
চেয়ারটা টেনে রজতাভ দত্তের পাশে বসা গেলো। কি নিয়ে যেন আলাপ করছিলেন এতোক্ষণ ধরে, তার উপসংহার টানলেন, ‘সব থেকে ইজি ডিপার্টমেন্ট হচ্ছে ক্যামেরা। যেখানটায় লোকজন বসে আছে, ওখান থেকে ক্যামেরাটা সরিয়ে দাও, দেখবে...’ বাকিটা অনুক্ত রইলো। আশীষ বিদ্যার্থী উঠে গেলেন।
বাংলানিউজ: কথা শুরু করবো?
রজতাভ দত্ত: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মাথার ওপর থেকে রিফ্লেক্টরটা উঠিয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো প্রোডাকশনের কয়েকজন। এবার কড়া রোদ। হাতে সোনালি রঙের হাতঘড়ি, গলার মোটা চেনটা রোদে আরও চকচক করছে। রজতাভ দত্ত বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। ’ অতএব, আলাপচারিতা চলবে।
বাংলানিউজ: আপনি যখন অন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে যান, তখন কী এটা মাথায় আসে যে, ইন্ডাস্ট্রিটা ছোট নাকি বড়? পপুলারিটি কেমন বা মার্কেট...
রজতাভ: অন্য ইন্ডাস্ট্রি বলে তো আসলে ওভাবে ভাবি না। ছোট-বড় ওসবও ব্যাপার না। আমার কাছে ভাষাটাই বরং জোরের জায়গা। হিন্দি-কোরিয়ান ভাষার ছবিতেও অভিনয় করেছি। কিন্তু বাংলায় যেভাবে আরামটা পাই, সেটা অন্য কোথাও পাই না।
এক ফাঁকে রজতাভ দত্তের মাথার ওপরে ছাতা ধরেছে প্রোডাকশন বয়। আলাপচারিতায় ঢুকে পড়ে সিনেমার ভিন্ন দু’টো ধরণ। গতানুগতিক প্রেম, বিদেশের রাস্তায় নাচ, নায়কের হিরোইজম- উপাদান হিসেবে চলচ্চিত্রের এই ধারাটির দর্শকপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। ভালোলাগার তালিকায় বরং উঠে আসছে একটু অন্যরকম, জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের ছবি। ব্যাখ্যা দিলেন ‘মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার’-এর বিচারক।
রজতাভ: মার্কেটটা ওঠানামা করে। কখনও এটা হয়তো একটু বেশি ব্যবসা করলো, কখনও ওটা। আবার কখনও পরিচালক দর্শককে প্রথম দৃশ্যেই বুঝিয়ে দেন, তুমি এ গল্পটা জানো না। একেবারেই নতুন। কাজেই যখন একধরনের গল্প কিছুদিন ঘোরে বা এক ধরনের ছক থাকে উপস্থাপনে; লোকে একটু পরপর অনেকগুলো দেখে ফেলে, তখন তারা স্বাদ বদলাতে চায়। কাজেই দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক ছবি মূলধারার ব্যবসা করার কারণে, এখন আবার অন্য ধরনের ছবির বাজার তৈরি হচ্ছে। আবার এটা ঘুরে আসবে, ওটাও চলবে।
বাংলানিউজ: আপনার তো সুবিধা আছে। দু’ধরণের ছবিতেই দাপিয়ে অভিনয় করছেন।
রজতাভ: আমার ক্ষেত্রে সুবিধে হচ্ছে, আমি ওইরকমভাবে তো ঠিক করিনি। নিজেকে পেশাদার অভিনেতা হিসেবেই দেখেছি। এটা আমার কাছে বড় একটা ব্যাপার যে দু’ধরনের ছবিতেই কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই দু’টোকেই আমি সম্মান করি। দু’টো কাজ করার সময়, দু’টো ধরনে... মানে আমি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, আমার কাছে ব্যাপারটা ফুটবল ও দাবা খেলার মতো। বাণিজ্যিক ছবি হয় দক্ষতা নির্ভর। অবশ্যই সেখানটায় মস্তিষ্ক লাগে। বুঝতে হয় যে কীভাবে আমি ফাঁকটা খুঁজে নেবো গোল করার জন্য। কিন্তু মূলত সেটা শারীরিব একটা দক্ষতা বা পরিশ্রমের ওপর চলে। আমি সবসময় একটা ধাঁধা লাগানোর চেষ্টা করতে থাকি তখন। প্রত্যেকটা ফ্রেমের মধ্যে। আর যেটা নাকি অফবিট ছবি, সিরিয়াস ছবি বলছি; সেটা দাবা খেলার মতো। ওখানেও শারীরিক সক্ষমতা দরকার হয়। বড় বড় দাবাড়ু আছেন, যারা জিম করেন রোজ দেড়ঘণ্টা করে। কারণ অতোক্ষণ বসে থেকে মনোযোগ রাখার জন্য ওই শারীরিক সক্ষমতার দরকার পড়ে। কিন্তু দর্শকের সামনে সেটা ধরা পড়ে না।
বাংলানিউজ: দেখা যায় একজন লোক ভাবছে এবং চাল দিচ্ছে...
রজতাভ: ঠিক। সিরিয়াস ফিল্মে, যেখানটায় শারীরিক সক্ষমতা থাকলেও, সেটার শক্তিটাকে কোথাও লুকিয়ে শুধু মেধা বা বুদ্ধিটা কাজে লাগানো হয়। কাজেই এ দু’টোই দরকার হয় একজন অভিনেতার জন্য। সবাই, আমার মনে হয়, দু’টো কাজই করতে চায়।
বাংলানিউজ: রজতাভ দত্ত কি শুধু মঞ্চে-পর্দায় অভিনয়টাই করে যাবেন? নাকি চিত্রনাট্য, পরিচালনা ওদিকেও আগ্রহ আছে?
রজতাভ দত্ত হাসলেন। আশপাশের ভিড় সরে গেছে কিছুক্ষণ আগে। তারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে, যেখানে ক্যামেরা রাখা। দু’একজন সহকারী মাঝে মধ্যে চিৎকার করছে, ‘জোন ক্লিয়ার’। প্রস্তুত করা হচ্ছে ক্রেন। রজতাভ সেদিকটা একবার দেখে নিলেন। তারপর উত্তর দিলেন।
রজতাভ: প্রথমত সেগুলো সময়সাপেক্ষ। জানি না যোগ্যতা আমার আছে কি-না, যদিবা থেকেও থাকে, পাঁচ মাস একটা কাজ নিয়ে আটকে থাকার সময়ের খুব অভাব। থিয়েটারটাই অনেক কষ্ট করে করি। কারণ, এজন্য প্রায় এক মাস আগে প্রস্তুতি নিতে হয়। কখনও পরিচালনার কথা ভাবিনি। ইচ্ছে থাকলেও, জানি আমি পেরে উঠবো না। পরিচালনা আরেকটা বড় জিনিস হচ্ছে, সৃজনশীলতার জায়গা ছাড়াও নেতৃত্ব গুণের দরকার হয়। আমার ওটা নেই। আমি মূলত কর্মী।
আর সময় নেই। ক্রেনে ক্যামেরা ঝুলিয়ে শট দেখে নেওয়া হচ্ছে। রজতাভকে এবার যেতে হবে। ফাঁকা জায়গাটায় দু’টো গ্রুপ দাঁড়িয়ে যাবে। পরস্পরের চ্যালেঞ্জ ছোঁড়াছুড়ি চলবে। তারপরের গল্পটা মুখস্ত! না দেখেও দিব্যি বলে দেওয়া যায়! রজতাভ দত্ত বাংলাদেশে এসেছেন ‘অঙ্গার’ ছবির কাজে। ছবিটি পরিচালনা করছেন ওয়াজেদ আলী সুমন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ