মনিরুল ইসলাম মনি। একসময় কাজ করতেন একুশে টেলিভিশনে।
বাংলানিউজ : এশিয়ান টিভিতে আপনি যোগ দিয়েছেন এ বছরের ১ জুলাই। দায়িত্ব নেওয়ার পর কী কী পরিবর্তন এনেছেন এই চ্যানেলে?
মনিরুল ইসলাম মনি : খুব বেশি সময় কিন্তু যায়নি আমার আসার পর। সাড়ে তিন মাসও হয়নি। তবুও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি খবরের ওপর আমরা জোর দিয়েছি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, ঈদুল আজহায় সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে এমন সংগীতানুষ্ঠানগুলোতে শুধু দেশি শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আগে প্রায় সব ঈদে ভারতীয় শিল্পীরা এসে গান করেছেন এশিয়ান টিভিতে। আমরা সেখান থেকে সরে এসেছি। ভালো ও জনপ্রিয় নির্মাতাদের নাটক প্রচার করেছি ঈদে। তাদের অনেকের নাটক এর আগে এই চ্যানেলে প্রচার হয়নি। এসব উদ্যোগ নিয়ে সাড়াও পেয়েছি ব্যাপক।
বাংলানিউজ : অনুষ্ঠান সাজানোর ক্ষেত্রে আপনি কোন দিকটিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?
মনি : আমরা দর্শকদের কথা মাথায় রাখি সবার আগে। কোন সময়ে কোন অনুষ্ঠান কোন বয়সের দর্শকরা দেখবে, সেটা নিয়ে ভাবি। নারী বা পুরুষরা কখন টিভি বেশি দেখে সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করি। তারপর অনুষ্ঠান বিভাগকে পরামর্শ দেই। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে চ্যানেলকে আগে জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতে হয়। সরাসরি কর্মকান্ড বাড়ানো গেলে দর্শকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে। আমাদের তেমন কিছু পরিকল্পনা আছে।
বাংলানিউজ : টিভি চ্যানেলে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করার চ্যালেঞ্জ কোথায়?
মনি : সাফল্য ধরে রেখে নতুন কিছু অর্জন করাটাই মার্কেটিং বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখানে। সত্যি বলতে আমাদের এখানে মার্কেটিং নামেমাত্র, আসলে আমরা সেলসকেন্দ্রিক কাজই করি। সেলস টিমও বলতে পারেন। টাকা-পয়সার হিসাব নিয়েই দিন কেটে যায়, চ্যানেলের ব্র্যান্ডিং নিয়ে আমরা খুব একটা কাজ করার সুযোগ পাই না। এসবের মধ্যেও আমি কিন্তু চেষ্টা করি।
বাংলানিউজ : দেশে এখন অনেক টিভি চ্যানেল। আপনি কি এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখেন?
মনি : মোটেও না। কারণ বাংলাদেশের আয়তন আর জনগোষ্ঠীর অনুপাতে দশটা টিভি চ্যানেলই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু সেটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ কারণে নতুন চ্যানেলগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। উপযুক্ত লোকবল বা পরিকল্পনা না থাকলে এগোনো যায় না। শেষমেষ দেখা যাবে চ্যানেলটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তখন উদ্যোক্তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। সরকারও কেনো এই সময়ে এসেও নতুন নতুন টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দিচ্ছে বুঝতে পারি না। আর উদ্যোক্তারাই বা কেনো নতুন লাইসেন্স নিচ্ছেন তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। যদিও নতুন নতুন চ্যানেল হওয়ায় কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। অনেক ছেলেমেয়ে কাজ শিখতে পারছে।
বাংলানিউজ : সাম্প্রতিক সময়ে টিভি চ্যানেলগুলোর অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন বিরতির কারণে দর্শকদের বিরক্তি চরমে উঠেছে। এটাকে সুষ্ঠুভাবে তত্ত্বাবধানের উপায় কী?
মনি : অনেক চ্যানেল হওয়ার কারণে এ সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের বাজেট কিন্তু বাড়েনি। তারা একই বাজেট সব চ্যানেলকে ভাগ করে দিচ্ছেন। এ কারণে প্রতি মিনিটের মূল্য কমে গেছে। আগে যেমন ১০টা চ্যানেলকে তারা বিজ্ঞাপন দিতেন, এখন একই বাজেট থেকে তা পাচ্ছে ২০টির মতো চ্যানেল। বিজ্ঞাপনের দাম বেড়ে গেলে আমরা সর্বোচ্চ তিন-চার মিনিটের বিরতিতে গিয়ে ফিরে আসতে পারতাম। এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না টিকে থাকার তাগিদে। বিজ্ঞাপন মূল্য কম হওয়ায় বেশি বিজ্ঞাপন চালাতে হচ্ছে আমাদেরকে। ধরুন এই ঘরে সাতজন মানুষ আছেন। সবার জন্য একটা কেক আনা হলো। মানুষ যদি ২৫ জন হয়ে যায়, তখনও এই একটা কেক থেকেই কিন্তু তাদেরকে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরিমাণ এমনিতেই কমে যায়। উদ্যোক্তারাও চ্যানেল প্রতিষ্ঠার এক-দুই বছর পর বিজ্ঞাপনের টাকা দিয়ে চ্যানেল চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাই মার্কেটিং বিভাগকে স্বাভাবিকভাবেই বেশি বিজ্ঞাপন চালাতে হয়।
বাংলানিউজ : আপনি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের (ইমা) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি। কিন্তু এই সংগঠন এখন তেমনভাবে সক্রিয় নয়। বিজ্ঞাপন বিরক্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে কি ইমা ভূমিকা রাখতে পারে?
মনি : অবশ্যই রাখতে পারে। ২০০৯ সালে আমরা মূলত ইমা গঠন করেছিলাম টিভি চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগের চাকরিজীবীদের কল্যাণে। শুরুতে আমরা চার-পাঁচটি চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ বসেছিলাম। তখন আমাদের এক সহযোদ্ধা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তার চ্যানেল থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। তাই আমরা সব চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগের লোকজন একদিনের বেতন জমিয়ে তাকে দিয়েছিলাম। আসলে আমাদের মার্কেটিং বিভাগের পদগুলো খুব ক্ষণস্থায়ী। দেখা যায় অল্প সময়েই এই চ্যানেল থেকে ওই চ্যানেলে যাচ্ছি। সেজন্যই ইমা গঠন করা, যেন এর মাধ্যমে আমরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারি। এখন আমাদের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ২৫০। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ইমা অবদান রাখতে পারতো। কিন্তু বিভিন্ন চাপে ইমা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। চ্যানেলের উদ্যোক্তাদের যেমন চাপ আছে, তেমনি বিজ্ঞাপনদাতাদেরও চাপ আছে।
বাংলানিউজ : এসব চাপ উতরে আসার কী পরিকল্পনা আছে ইমার?
মনি : সামনে আমাদের একটি সভা হবে। ওখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো এসব চাপ থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবো। ওইদিন এমন কয়েকটি ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। আমরা ধারণা সবাই একসঙ্গে বসলে একটা সমাধানে আসা যাবে। অবশ্য চ্যানেলের মালিকদের সংগঠন অ্যাডকোর সব সদস্য একত্র হয়ে গেলে ইমার কাজটা সহজ হয়ে যেতো। আসলে আমরা মিডিয়ায় কাজ করি পাগলরা! তাই এতো প্রতিবন্ধকতা আর চাপের মধ্যেও হাসিমুখে থাকি। ভালো কাজের চেষ্টা করি।
বাংলানিউজ : আমাদের দেশে টিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতাদের মনোভাবটা কেমন বলে মনে হয়?
মনি : প্লাস্টিক ব্যবসায়ী বা গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা নিজেদের টিভি চ্যানেল প্লাস্টিক আর কাপড়ের ব্যবসার মতো চালাতে চাইলে কিন্তু টিকে থাকতে পারবেন না। তাদেরকে বুঝতে হবে, টিভি অনুষ্ঠানের মার্কেটিং আর প্লাস্টিক কিংবা কাপড় ব্যবসা এক নয়। তারা দিনের শেষে বা মাস শেষে দেখেন কালেকশন কতো হলো। ব্র্যান্ডিং বা চ্যানেলের মনোন্নয়ন কতোটা হলো সেদিকে মনোযোগ নেই তাদের। তাই আমাদেরকে নিজেদের পাশাপাশি চ্যানেলের উদ্যোক্তাদেরকেও শিক্ষিত হতে হবে।
বাংলানিউজ : একটি নতুন টিভি চ্যানেলের কেমন পরিকল্পনা থাকা উচিত বলে মনে করেন?
মনি : আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠান ও খবরের সম্মিলন করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি হয়ে যায়। শুধু অনুষ্ঠান কিংবা শুধু সংবাদ হলে জনবলও কম লাগে, ফোকাস করাও সহজ হয়। শুধু খেলা অথবা কার্টুন কিংবা চলচ্চিত্র নিয়ে পৃথক চ্যানেল হতে পারে। নতুন চ্যানেলগুলোর গবেষণা দল থাকা জরুরি। আপনি হয়তো জানেন, সিরিয়াস নামে আমাদের এখানে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ওপর টিআরপি নির্ধারণ হয়। তারা শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটা কিন্তু আমাদের ৬৪ হাজার গ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এজন্য টিভি চ্যানেলগুলোর জরিপ দল থাকা দরকার। পরিকল্পনা তো অবশ্যই লাগবে। আমাদের দেশে কোনো চ্যানেলই বাজার বা দর্শক নিয়ে গবেষণা করে না। বাইরের দেশের চ্যানেলগুলো কিন্তু গবেষণা না করে কোনো অনুষ্ঠান তৈরি করে না। এমনকি প্রচারের পরও তারা গবেষণা করে। একুশে টিভি শুরুর দিকে এ কাজটা করতো।
বাংলানিউজ : আপনি একুশে টিভিতে দীর্ঘদিন ছিলেন। সে হিসেবে অনেকদিন ধরে টিভি চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগে কাজ করছেন। আপনার আগামী পরিকল্পনা কী?
মনি : খেলা নিয়ে দেশের প্রথম হোমসিরিজের মার্কেটিং হয়েছে আমার হাত দিয়ে। জিটিভিতে এ কাজটা করেছি। সামনে এমন নতুন নতুন আরও কাজ করার ইচ্ছে তো আছেই। পুরো দেশ সম্পৃক্ত থাকবে এমন একটা আয়োজন করতে চাই টিভি চ্যানেলে। তাহলে ব্র্যান্ডের ভিত্তি মজবুত হবে। একটা কর্মশালা চালু করতে চাই টিভি চ্যানেলের মার্কেটিং নিয়ে। নতুন যারা আসে তারা হিমশিম খায়, তাই এমন কর্মশালা হলে তারাও উপকৃত হবে। আসলে জনসংযোগই আমাদের মূল পূঁজি। যার জনসংযোগ যতো ভালো, সে ততো সফল হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৫
জেএইচ