কাশ্মীরী নারীদের এ সংগ্রাম-দুঃখগাঁথা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। সেই প্রতিবেদনটিই তুলে ধরা হলো।
এমন পরিস্থিতি একেবারেই নতুন কাশ্মীরের জন্য। এর আগে এ জনপদে সংঘাত-সংকট দেখা দিলেও মিটমাট হয়ে যেত কিছু সময় পর। শান্ত হয়ে যেত পরিস্থিতি। কিন্তু এখন আর আগের পরিস্থিতি নেই। ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, কাশ্মীর যেন উন্মুক্ত কারাগার!
গত ৫ আগস্ট ভারত সরকার তাদের শাসিত অঞ্চল কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদায় সংবিধানে সংরক্ষিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেয়। সেই বিশেষ মর্যাদা খুইয়ে কাশ্মীর এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এরপর থেকেই জনপদজুড়ে অনিশ্চয়তার মেঘ।
চার মাসে পা দিয়েছে কাশ্মীরে অঘোষিত ভারতীয় ‘অবরোধ’। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর অগুনতি সদস্য। প্রতিটি সড়কে তাদের সরব উপস্থিতি বলে দেয় কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা। কারফিউ তো জারি করা হয়েছেই, গ্রেফতারও করা হয়েছে অসংখ্য কাশ্মীরীকে। ইন্টারনেট, টেলিফোন সেবা থেকে শুরু করে বন্ধ করে দেওয়া হয় এ জনপদের সঙ্গে বিশ্বের যোগাযোগের সম্ভাব্য সব পথ। এমনকি বন্ধ করে দেওয়া হয় গণপরিবহন সেবাও।
যদিও সম্প্রতি কারফিউ তুলে নেওয়া, সীমিত পরিসরে মোবাইল সেবা চালু, রোডব্লক সরিয়ে নেওয়াসহ কিছু বিষয় শিথিল করেছে ভারত সরকার। কর্তৃপক্ষের দাবি, সড়কে সহিংসতা ঠেকাতেই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, বলতে গেলে যা এ অঞ্চলে স্বাভাবিক ঘটনা। এতকিছুর পরও পরিস্থিতির বদল কিন্তু তেমন একটা ঘটেনি বললেই চলে। কেন্দ্রীয় সরকারের নানা পদক্ষেপ উল্টো ভোগান্তি বাড়াচ্ছে জনপদের বাসিন্দাদের।
ইতোমধ্যে ভারতীয় বাহিনীর এ নিয়ন্ত্রণ এখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনে বাজে প্রভাব ফেলা শুরু করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে জনপদের পুরুষরা অন্যতম লক্ষ্য হলেও এখানকার নারীদের ভোগান্তি তাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
নারীদের ভোগান্তির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেওয়া সন্তানের ব্যাপারে হাসপাতাল থেকে হালনাগাদ তথ্য নিতে পারেননি এক মা। নিজের বিয়ে নিয়ে সাজিয়ে রাখা সব পরিকল্পনা চুলোয় গেছে তরুণীর। আর নারী হওয়ার পাশাপাশি পেশাগত কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে দ্বিগুণ হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন এক নারী আলোকচিত্র সাংবাদিক।
‘অবরোধ’ এর মধ্যে জাহিদা জাহাঙ্গীরের কোল আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিল এক ছেলে শিশু। যদিও তার জন্ম হয় নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগে। জন্ম নেওয়ার পর তাকে ক্লিনিক থেকে শহরের একটি শিশু পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে জাহিদা তার সন্তানকে দেখতে যেতে পারেননি। এমনকি তিনি কোনোভাবে তার সন্তানের খোঁজ নিতে যোগাযোগ করতে পারেননি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও। সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানের কাছ থেকে দূরে থাকার যে বেদনা তা মা মাত্রই উপলব্ধি করার কথা। এ দুঃখ তাকে নিঃসন্দেহে পুরো জীবনই বয়ে বেড়াতে হবে।
কুলসুমা রমিজের দুঃখের গল্পটা জাহিদার চেয়ে ভিন্ন। এ অবরোধ পরিস্থিতির মধ্যেই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল তার। কিন্তু বিয়ের জন্য কোনো শপিং করা হয়নি। কেনা হয়নি পছন্দ করে রাখা বিয়ের পোশাক। উল্টো ধার করা পোশাকেই সারতে হয়েছে বিয়ের কাজ। আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের নিয়ে অত্যন্ত ছোট পরিসরে করা হয়েছে অনুষ্ঠান। সড়ক বন্ধ থাকায় অনুষ্ঠান শেষে তাকে পায়ে হেঁটেই যেতে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি।
মাসরাত জাহরা একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর প্রথম শুক্রবারের প্রতিবাদ সমাবেশের ছবি তুলছিলেন তিনি। সেসময় এক পুলিশ কর্মকর্তা লাথি মারার হুমকি দিয়েছেন তাকে।
পুলিশ কর্মকর্তার হুমকির বিষয়ে জাহরা বলেন, ‘আমাকে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, আমি তোমাকে বুট দিয়ে লাথি দেবো, এরপর নিয়ে যাবো গভর্নরের কাছে। ’
যদিও জাহরা এ হুমকিতে নিজের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি।
‘আপনি কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে পারেন না। আপনি বের হয়ে আসেন এবং কথা বলেন। আপনার আওয়াজ নিশ্চয় কেউ না কেউ শুনবে। আর আমার প্রতিবাদের ধরন হচ্ছে কাজের জন্য বের হওয়া’, বলেন মাসরাত জাহরা।
এ আলোকচিত্র সাংবাদিক জানান, কাশ্মীরী মেয়েরা কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাড়ির বাইরে হয়রানির ভয়ে বের হতে পারেন না। কারণ বাইরে হায়েনার মতো লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
২২ বছর বয়সী একমাত্র সন্তান ফয়সাল আসলাম মীর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর থেকেই বাড়িতে একা আতিকা বেগম। তার জন্য ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আটক হয়েছিলেন ফয়সাল। সে বিষয়ে আতিকা বলেন, ‘আমার সন্তানকে হয়তো ভারতের কোনো একটি শহরের জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। যেখানে তাকে দেখতে যাওয়ার কোনো উপায় আমার হাতে নেই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৯
এইচএডি/এইচএ/