বেআইনি অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য নেপালকেই বেছে নিচ্ছে চীনারা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিত করেই বলা যায়, নেপালই হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক পাচারচক্রে জড়িত চীনা নাগরিকদের স্বর্গরাজ্য।
করোনা অতিমারির কারণে লকডাউনের সময়েও ভারতীয় শুল্ক বিভাগের বিদেশি সোনা জব্দ করেই আয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ। কারণ চোরা কারবারীরা এখন বিমান পথের বদলে নেপালের খোলামেলা সীমান্ত দিয়েই পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের জাল বিস্তারে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে। জুলাই মাসেই ৩৩.৫ কেজি সোনা জব্দ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো। হরিসারণ খাড়কা নামে এক ব্যক্তি গ্রেপ্তারের পর পুরো বিষয়টি সামনে চলে আসে। ধরা পড়ে চোরাকারবার রোধে নেপালের গাফিলতি।
নেপালে সোনা পাচারকারীদের মধ্যে চীনের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি জড়িত। গত ৫ বছরের পুলিশ রেকর্ড বলছে, অন্তত ২০০ চীনা ধরা পড়েছে নেপালে। শুধু সোনা পাচারই নয়, ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, এটিএম হ্যাকিং, টাকা পাচার, মানব পাচার, পশুপাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত চীনারা। দেখা যাচ্ছে চীনারা নেপালের মাটি ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। নেপালকে কেন্দ্র করে তারা গড়ে তুলেছে অপরাধচক্র। সাইবার ক্রাইম, অনলাইন জুয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চীনা অর্থনৈতিক অপরাধের রাজধানী হয়ে উঠেছে কাঠমান্ডু।
নেপালে চীনা অপরাধ চক্রের আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে বছর খানেক আগের একটি ঘটনা থেকে। ২০১৯-এর ২৩ ডিসেম্বর কাঠমান্ডু থেকে ১২২ জন চাইনিজ গ্রেপ্তার হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু নেপালকে এই ঘটনার তদন্তটুকুও করতে দেয়নি চীন। চীনের পাবলিক সিকিওরিটি এজেন্সি তদন্তে নেমে যাবতীয় তথ্য নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ওয়াং শিয়াওহং-এর নেতৃত্বে ললিতপুর, বালাচু, মহারাজগঞ্জ ও বুধাননীলকন্ঠ-সহ কাঠমান্ডুর বিভিন্ন জায়গায় চলে তল্লাশি। কিন্তু চীনের চেন সিতিয়ান, ওউ রোংফেং. ইউ ওয়াইহাই, ঝ্যাং ঝ্যাংপো, চু চিং., ইয়াং ডং, শিয়াও চাও-এর মতো আন্তর্জাতিকস্তরে কুখ্যাত অপরাধীরা তল্লাশি অভিযান শুরুর আগেই রহস্যজনকভাবে ফিলিপিনসে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নেপাল পুলিশকে বাদ দিয়েই চীনা নিরাপত্তা আধিকারিকরা নেপালে তল্লাশি চালিয়ে ৭৪৭টি মোবাইল ফোন, ৩৩১ টি ল্যাপটর, ৯৮টি সিপিইউ, ৯৯টি মনিটর, ২২টি পেন ড্রাইভ এবং ৩২৭টি সিম কার্ড বাজেয়াপ্ত করে।
জানা যায়, নেপালে বসে চীনা চোরাকারবারীরা ২১টি সফটওয়্যার কোম্পানি চালাচ্ছিল। ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লেনদেন হয় কাঠমান্ডু থেকে। অথচ এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরও নেপাল স্বাধীনভাবে কোনও তদন্তেই নামেনি। অথচ তাদের মাটি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র চালাচ্ছে চীনা অপরাধীরা। নেপালে এতো বড় অপরাধচক্রের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলেও চীন অবশ্য দোষ চাপিয়েছে উইগুর মুসলিম আর হংকং-এর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রকের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেছিলেন, 'ধৃতেরা চীনের উদ্বেগের কারণ। এটা উইগুর বিচ্ছিন্নতাবাদী ও হংকং-এর গণতন্ত্রের নামে আন্দোলনরতদের কাজ। '
চীনের সঙ্গে নেপালের কোনও বন্দি প্রত্যার্পন চুক্তি ছিলো না। ২০১৯-এর অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাঠমান্ডু সফরকালে দুই দেশ অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে পারস্পরিক আইনি সহায়তার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী নেপাল ইচ্ছা করলে কোনও চীনা অপরাধীকে বেজিং-এর হাতে তুলে দিতে পারে। কিন্তু সূত্রের খবর, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চাপে অর্থনৈতিক অপরাধে ধৃতদের সকলকেই চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় নেপাল।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২টি চার্টার্ড প্লেনে করে ধৃত চীনা জালিয়াতদের নিজের দেশে নিয়ে যায় চীন। অনেকেই মনে করেন, নেপালে বিচার ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করে চীন নেপালের জনগণকে অন্ধকারে রেখে অপরাধীদের কাঠমান্ডু থেকে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীনা হস্তক্ষেপের এটাও এতটা বড় প্রমাণ। নেপালের সার্বভৌমত্বও আজ প্রশ্ন চিহ্নের সামনে।
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ চলতি বছরে অর্থ পাচার বিরোধী (এএমএল) এবং সন্ত্রাসীদের অর্থায়ণ প্রতিরোধ (সিএফটি)-এ নেপালের ভূমিকা খতিয়ে দেখবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স ২০০৯ সালেই নেপালকে ধূসর তালিকাভুক্ত করে। তবে ২০১৪ সালে সেই তালিকা থেকে মুক্তি পায় নেপাল। কিন্তু চীনা জালিয়াতদের কারণে ফের আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কূনজরে পড়তে পারে নেপাল।
জানা গেছে, বর্তমানে ৮০০ চীনা প্রতারক সেখানে আর্থিক অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। নেপাল সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই অপরাধ দমনে। বরং অনেক দেশই নেপালও জড়িত বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছে।
আমেরিকার ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক গত বছর সেপ্টেম্বরে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফিনসেন ফাইল নামে পরিচিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু নেপালি ব্যাঙ্ক ও সংস্থা চীনের সঙ্গে ইরানের যোগসূত্র হিসাবে কাজ করছে। এই ফাইলেই উল্লেখ রয়েছে অন্তত ১০টি নেপালি সংস্থার রহস্যজনক অর্থ লেনদেনের। ফিনসেন ফাইল অনুযায়ী ৯টি ব্যাঙ্ক, ১০টি সংস্থা ছাড়াও বহু নেপালি আন্তর্জাতিক ব্যবসার নামে মোটা টাকা রহস্যজনকভাবে লেনেদেন যুক্ত। ১১ বছরে ২৯২.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লেনদেন হয়েছে নেপাল থেকে। ফিনসেন বলছে, নেপালি কোম্পানি রৌনিয়ার ব্রাদার্স ইরান থেকে মাল এনে সেই মাল দুবাই থেকে আমদানিকৃত বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর তদন্তেও উঠে এসেছে নেপালের জালিয়াতির উদাহরণ। ইরানের 'বন্দর আব্বাস' থেকে মাল নিয়ে এসে ভূয়া কাগজ পত্রে নেপাল দেখিয়েছে দুবাইয়ের 'জেবেল আলি' বন্দরের নাম।
ফিনসেনের প্রতিবেদনে পুরাকীর্তি পাচারেও নেপালের নাম উঠে এসেছে। নেপালি ব্যবসায়ীরা অনেকেই সোনা, পুরনো ধাতবমূর্তি, বিটুমিন, টেলিফোনের যন্ত্রাংশ চোরাকারবারেও যুক্ত। বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে নেপালের ব্যাঙ্কগুলি আসলে মানি লন্ডারিংকেই উৎসাহিত করে চলেছে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চীনের ঝংজিং টেলিকম্যুনিকেশন ইক্যুপমেন্ট বা জেটিই ২১৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামগ্রী নেপালসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে রেড ক্রশের স্টিকার লাগিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে। চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেপাল দেশের অ্যাসেট (মানি) লন্ডারিং প্রিভেনশন রুলস, ২০০৮ (এএলপিএ)-কেও বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।
নেপালে অর্থ পাচার আর সন্ত্রাসীদের অর্থায়ণ বন্ধে তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। নগদ অর্থের কারবারি দেশটিতে সহজেই অর্থপাচারকারীরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন। বাড়ছে অর্থনৈতিক অপরাধের মাত্রাও। চীনা জালিয়াতদের উপস্থিতি শুধু নেপালের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলার পক্ষেই ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে না, দেশের আর্থিক মেরুদন্ডও পঙ্গু হতে বসেছে। নেপাল কিন্তু শিগগিরই 'ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র' বা হাই রিস্ক কান্ট্রির তালিকায়ও উঠে আসতে পারে। তাই নেপাল সরকারকে অর্থ পাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধ দমনে সক্রিয় হতেই হবে। নইলে নানারকম অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়তে হতে পারে। চীনকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজেদের দেশের সর্বনাশ মোটেই কাম্য নয়। তাই চীনের অর্থনৈতিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিক নেপাল, এটাই চাইছে আন্তর্জাতিক দুনিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১
নিউজ ডেস্ক