‘ওমিক্রন’ নামে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টটি আবিষ্কারের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাধুবাদের পরিবর্তে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ তুলেছে বলে রোববার (২৮ নভেম্বর) জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।
মূলত এই ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের পরেই বিভিন্ন দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তার ভিত্তিতে শনিবার দেওয়া ওই বিবৃতিতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিজ্ঞানের চমৎকারিত্বের প্রশংসা করা উচিত। শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। নতুন ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত শনাক্ত করতে উন্নত জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সক্ষমতা থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যখন বিশ্বের অন্য কোনো দেশ নতুন ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কার করেছিল, তখন প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রাথমিক তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে, ওমিক্রনে পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। অর্থাৎ একবার কেউ এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে তার পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে যে নতুন ধরনটি ‘উদ্বেগজনক। ’
ইউরোপে এখন বেশ কয়েকজনের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে যুক্তরাজ্যে দুই জন, জার্মানিতে দুই জন, বেলজিয়ামে একজন এবং আরেকজন ইতালিতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও চেক প্রজাতন্ত্রে একজন এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে ইসরায়েলও। এরপরই তারা রোববার মধ্যরাত থেকে ভিনদেশিদের ইসরায়েলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। এই নিষেধাজ্ঞা ১৪ দিন ধরে চলবে।
ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে বতসোয়ানা এবং হংকংয়েও। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নেদারল্যান্ডসে আসা শতাধিক যাত্রীদের পরীক্ষা করা দেখা হচ্ছে যে তাদের মধ্যে কেউ নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত কি-না। দুটি কেএলএম ফ্লাইটের প্রায় ৬১ জন যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফলে কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে। তাদের আরও পরীক্ষার জন্য আমস্টারডামের শিফোল বিমানবন্দরের কাছে একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
নেদারল্যান্ড বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। রোববার সন্ধ্যা থেকে দেশটিতে আংশিক লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হয়। এর আগে গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়টি প্রথমবারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানায়।
এদিকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির জন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী জানিয়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের ভ্যাকসিন ডেলিভারি অ্যালায়েন্সের কো-চেয়ার আয়োআদে আলাকিজা বলেন, এখন যা হচ্ছে এটাই হওয়ার ছিল। বিশ্ব একটি ন্যায়সঙ্গত, জরুরি এবং দ্রুত উপায়ে টিকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। এটি উচ্চ-আয়ের দেশগুলোর টিকা মজুদ করার ফল এবং এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাগুলো রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে হয়, বিজ্ঞানের ভিত্তিতে নয়। এটা ভুল হচ্ছে। যেখানে এই ভাইরাসটি ইতোমধ্যে তিনটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে আমরা কেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে বন্ধ করে দিচ্ছি?
শুক্র ও শনিবার বেশ কয়েকটি দেশ নতুন ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে:
১. দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, মালাউই, জাম্বিয়া, লেসোথো এবং এসওয়াতিনি থেকে কোনো ভ্রমণকারী যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না, যদি না তারা আইরিশ নাগরিক বা যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা হন।
২. মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, লেসোথো, এসওয়াতিনি, মোজাম্বিক এবং মালাউই থেকে বিদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে দেওয়া হবে না। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। সোমবার থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের কথা রয়েছে।
৩. অস্ট্রেলিয়া শনিবার ঘোষণা করেছে যে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, লেসোথো, এসওয়াতিনি, সেশেলস, মালাউই এবং মোজাম্বিক থেকে ১৪ দিনের জন্য ফ্লাইট স্থগিত করা হবে। অস্ট্রেলীয় নন এমন যারা গত দুই সপ্তাহে ওইসব দেশে ছিলেন তাদের এখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশে নিষেধ করা হয়েছে।
৪. জাপান ঘোষণা করেছে যে, শনিবার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা বেশিরভাগ ভ্রমণকারীদের ১০ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিন করতে হবে এবং সেই সময়ে মোট চারটি পরীক্ষা করতে হবে।
৫. দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা এবং হংকং থেকে আগত ভ্রমণকারীদের জন্য ভারত আরও কঠোর স্ক্রিনিং এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার আদেশ দিয়েছে।
৬. গত ১৪ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, লেসোথো, এসওয়াতিনি বা মোজাম্বিকে ভ্রমণ করেছেন এমন বিদেশি নাগরিকদের কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রাথমিকভাবে বি.১.১.৫২৯ নামে পরিচিত এই ভ্যারিয়েন্টটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব প্রদেশে বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এর প্রভাব কতটা তীব্র, সেটা বুঝতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। কারণ এটি কতটা সংক্রামক তা বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখা করার চেষ্টা করছেন।
যুক্তরাজ্যের এক শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলো অবশ্যই কম কার্যকর হবে। তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল বায়োলজিস্ট প্রফেসর জেমস নাইসমিথ বলেছেন, এটা খারাপ খবর। কিন্তু এটাই শেষ নয়।
দক্ষিণ আফ্রিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান অ্যাঞ্জেলিক কোয়েতজি বলেন, দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের যেসব খবর পাওয়া গেছে, তাতে কোভিড পরিস্থিতি এতটা গুরুতর ছিল না। সেখানে মাত্র ২৪ শতাংশ জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে তদন্ত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। রোগীরা বেশীরভাগই শরীর ব্যথা, ক্লান্তি ও চরম ক্লান্তিতে ভোগার কথা বলেছেন। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন অল্প বয়সীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০২১
এনএসআর