২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে মার্কিন মসনদে বসেন জো বাইডেন। রিপাবলিকানদের হারিয়ে ডেমোক্র্যাট এই প্রেসিডেন্ট গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র শাসন করছেন।
এ নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগ্য। অপরদিকে, বাইডেনও যে নৌকার পালে হাওয়া লাগিয়ে ভাসবেন তারও উপায় নেই। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বাকি মেয়াদ কেমন যাবে সেটিও নির্ভর করছে মার্কিনিদের ভোটের ওপর।
বিবিসি, সিএনএন, এপি এবং আল জাজিরাসহ শীর্ষ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ঘেঁটে জানা গেছে, এ নির্বাচনে হোয়াইট হাউসে যদি রিপাবলিকানরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে বেকায়দায় পড়বেন জো বাইডেন। করোনা, গর্ভপাত আইনসহ বেশ কিছু ইস্যুতে তিনি ও তার দল আটকে যেতে পারেন। পাশাপাশি বাধার সম্মুখীন হবেন বিভিন্ন ধরনের আইন পাশে।
জাতীয় নির্বাচনের শুরু থেকেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন জনপ্রিয় ছিলেন। নির্বাচনের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ডেমোক্র্যাটিকরা। সেটি ধরেও রেখেছেন তারা। ফলে কোনো আইন পাস বাইডেনের জন্য সহজ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপ দেখায়, এবার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’র নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন রিপাবলিকানরা। আবার ডেমোক্র্যাটরা সিনেটে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের চার বছর মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে হওয়া নির্বাচনটি (মধ্যবর্তী) তার ক্ষমতা ধরে রাখা ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের অন্যতম মাধ্যম। তবে, এ নির্বাচন যে শুধু প্রেসিডেন্টের জন্যই হয়, তা নয়। ভোট হয় গভর্নর এবং অ্যাটর্নি জেনারেল পদেও। তা ছাড়া কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করা হয় এর মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটের সদস্য সংখ্যা ১০০। এর মধ্যে ৩৫টিতে ভোট হবে মঙ্গলবার। প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গভর্নর পদে ভোট হবে ৫০ রাজ্যের মধ্যে ৩৬টিতে। নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হবেন ১৯ জন।
সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৫০/৫০ ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের। প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের ২২০টি ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে। বাকি ২১২টি রিপাবলিকানের হাতে। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যেকোনো দলকে ৫১ আসনে জয় পেতে হয়। আসনগুলোর ২০টিতে এগিয়ে রিপাবলিকান। ১২টিতে রয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে তিনটি আসন। প্রতিনিধি পরিষদে ২১৮টি আসনে জয় পেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যায়।
মধ্যবর্তী নির্বাচন ট্রাম্পের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প অংশ নেবেন বলে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সোমবার (৭ নভেম্বর) তিনি জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে বিশাল একটি ঘোষণা দেবেন। ধারণা করা হচ্ছে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তাহলে ট্রাম্প আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন। যদি তা না হয়, সব আশা গুঁড়িয়ে যেতে পারে তার।
গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ নির্বাচনে ট্রাম্প প্রার্থী নন। কিন্তু তার নির্বাচিত কয়েক ডজন প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
আগামী নিয়ে চিন্তা করলেও মাঝে মধ্যে ট্রাম্পের হঠকারী কিছু সিদ্ধান্ত তাকে সমালোচনায় নিয়ে যায়। মধ্যবর্তী নির্বাচন নিজের দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও কিছু কিছু জায়গায় ট্রাম্প স্বেচ্ছাচারিতা দেখান। যেমন, এবার প্রবীণ রিপাবলিকান নেতাদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কয়েকজন নতুন সিনেট পদপ্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। ফলে বাদ পড়েছেন প্রথাগত রিপাবলিকান রাজনীতিবিদরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন পেয়েছেন জর্জিয়ার প্রাক্তন রাগবি খেলোয়াড় হার্শেল ওয়াকার, পেনসিলভেনিয়ায় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ডা. মেহমেত ওজ এবং ওহাইও’র জনপ্রিয় লেখক জেডি ভ্যান্স। যদি তারা জেতেন তাহলে ট্রাম্পের রাজনৈতিক সহজাত প্রবৃত্তি প্রমাণিত হবে। কিন্তু যদি কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যা কমে, নিজের হাতে গড়া প্রার্থীসহ সব দোষ ঘাড়ে চাপবে ট্রম্পের। ফলে রিপাবলিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি অনাস্থা বেড়ে যাবে। হতে পারে তারা ভিন্ন পদপ্রার্থী খুঁজবেন।
এদিকে, ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস ও টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট দুজনই নভেম্বরে পুন:নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।
ক্ষমতায় থেকেও কেন চিন্তা বাইডেনের?
২০২১ সালে প্রেসিডেন্টের আসন গ্রহণ করার পর বছর জুড়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও জনগণের আশা পূরণে বেশ সচেষ্ট ছিলেন জো বাইডেন। কিন্তু গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জনমত জরিপে তার রেটিং খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে। গ্রীষ্মকাল থেকে এর কিছুটা পরিবর্তন প্রতীয়মান হয়। কিন্তু নির্বাচনের প্রচারের চূড়ান্ত পর্বে মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার ও অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি জনগণের আস্থায় খড়্গ নামাতে পারে। ফলে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতা কিছুটা নড়ে যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই বছরের দায়িত্বে জলবায়ু পরিবর্তন, আগ্নেয়াস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ এবং দরিদ্র শিশুদের জন্য নতুন আইন চালু করতে পেরেছেন বাইডেন। যদিও কংগ্রেসে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামান্য ছিল। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত তাকে মানুষের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে মার্কিন সংসদের দুটি কক্ষের একটি যদি রিপাবলিকানরা নিয়ে নিতে পারে। পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বাইডেনের। কারণ, ডেমোক্র্যাটদের আনা বিল কংগ্রেসে পাস হওয়া ঠেকিয়ে দিতে পারবে রিপাবলিকানরা। এতে জনগণের স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এটি জটিলতা সৃষ্টি করবে।
যদি এমনটি হয়ে যায়, আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করতে বাইডেনের ভাগ্যে। প্রথমত, তার রাজনৈতিক দুর্বলতার লক্ষণ প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের মৌসুম শুরু হলে বাইডেনকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান করা হতে পারে।
৮ নভেম্বর নির্বাচনের আগে ভোটারদের সতর্ক করেছেন বাইডেন। তার ভাষ্য, মার্কিন গণতন্ত্র ঝুঁকিতে রয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে এক সমাপনী বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
সোমবার ওয়াশিংটনের বাইরে ঐতিহাসিক বোভি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন বাইডেন। এ সময় বলেন, নির্বাচনে রিপাবলিকানদের বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল কর দিতে পারে। তার যে অর্জন বা তার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যেসব অর্জন করেছে, তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বাইডেন বলেন, আমরা একটি পরিবর্তনের ফোঁটার সামনে। আমাদের গণতন্ত্র ঝুঁকিতে; যা রক্ষার দায়িত্ব আমার এবং আপনাদেরও। সে সময় এসে গেছে।
নির্বাচনটি বাইডেন ও ট্রাম্প দুজনের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের প্রার্থীরা যদি জিতে যান, ফিরে আসতে পারবেন তিনি। অপরদিকে, বাইডেন উপনীত হয়েছেন এক পরীক্ষার সামনে। কার জয় হবে, বলে দেবে নির্বাচনের ফলাফল।
সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, এপি এবং আল জাজিরা
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২২
এমজে