ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

পুতুলের বিয়ে ।। মীর আব্দুল আউয়াল

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৭ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৪
পুতুলের বিয়ে ।। মীর আব্দুল আউয়াল

গ্রীষ্মকাল। দুপুরের কড়া রোদ  ঘর থেকে বের হতে দিতে চায় না মোটেই।

চারদিকে প্রকৃতিতে খাঁ খাঁ করছে। আজ ছুটির দিন। তাই তুশি আর পুশি দুই বোন সাতসকালে বাড়ির আঙিনায় আমগাছের নীচে পুতুল খেলা নিয়ে মেতে উঠেছে। রয়েছে পাড়ার অন্য ছেলে-মেয়েরাও। বড় বোন তুশির ছেলের সঙ্গে ছোট বোন পুশির মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছে। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে সবাই বিয়ের আয়োজনে এখন ব্যস্ত। এমন সময় তাদের বাবা ইকবাল হোসেন সাহেব উপস্থিত হলেন।

-    তোমরা এখানে কী করছো মামণিরা?
-    আমরা এখানে বিয়ে বিয়ে খেলছি বাবা।
-    ঠিক আছে,তোমরা কোনো গণ্ডগোল কোরো না, কেমন?
-    জ্বী আচ্ছা।
ইকবাল সাহেব চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পুশির কান্নার শব্দ শোনা গেল। পুশি দারুণ আত্মবিশ্বাসী আর দৃঢ়চেতা মেয়ে। সে সাধারণত কাঁদে না। আজ কী কারণে সে কাঁদছে তা ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না তার মা জাহিদা বেগম।

হেঁশেলে তিনি তখন রান্না-বান্নার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। তবু হেঁশেল থেকে একটু সময় নিয়ে তাদের খেলার স্থানে এলেন জাহিদা।
-    কী হয়েছে মামণি। কাঁদছো কেন?
-    মা শোন, তুশি আমার মেয়ের সাথে ওর ছেলের বিয়েতে যৌতুক চায়। আমি গরিব মানুষ, কোত্থেকে যৌতুকের এতো টাকা দেব। গতবার সর্বনাশা রাক্ষসী পদ্মা আমার ঘরবাড়ি সবই কেড়ে নিয়ে আমাকে সর্বশান্ত করেছে। আজ কন্যা দায়গ্রস্ত মায়ের দিকে একটুও তাকাচ্ছে না তুশি। ও কী সত্যি সত্যি মানুষ! তুমিই বল মা? গৃহহীন বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে বরকে সাইকেল,ঘড়ি রেডিও দেয়া কী আমার পক্ষে এখনসম্ভব?


মেয়ের মুখে এমন দুখের কথায় মায়ের চোখে জলে এসে যায়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে যান তিনি। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যায় তার। তিনি অবাক হলেন এ ভেবে যে,বাস্তব জীবনের এমন সবচিত্র কোত্থেকে পেলো তার মেয়েরা। বিষয়টা বুঝতে পেরে জাহিদা তুশিকে বোঝালেন যে,য়ৌতুক দেয়া ও নেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই বিয়েতে যৌতুক নিতে নেই মা। এ নিয়ে পরে মামলা হবে। এমন সব ভুল কখনও করবে না মামণি। হেঁশেলে কাজের তাড়া থাকায় তাড়াতাড়ি সেখানে থেকে চলে যান তিনি।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর কাজী এসে তুশির ছেলে পুতুলের সাথে পুশির মেয়ে পুতুলের বিয়ে কার্য সুসম্পন্ন করলেন। তাল পাতার বাঁশি আর টিনের কৌটার ঢোলের শব্দে মুহূর্তে বাড়িঘর কাঁপিয়ে তুললো তারা। সব শেষে খাওয়া দাওয়া আরম্ভ হলো। ধুলোবালির কোর্মা-পোলাও আর কাদার পিঠে খেয়ে বরযাত্রীরা মহাখুশি। এমন ভালো আয়োজনে বরপক্ষ আনন্দে আটখানা হয়ে গেল।
   
বিয়ের পরে কনের বিদায় নিয়ে তুমুল কাণ্ড আরাম্ভ হলো। তখন চারদিকে কান্নার রোল পড়ল। সব ছেলে মেয়েরা নববধূ পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি আরম্ভ করল। পুশির কান্না যেন আর থামে না। তার মেয়েকে সে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে মাটিতে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। তার একমাত্র মেয়েকে বিদায় দিয়ে সে এখন কী করবে? কেমন করে একলা ঘরে থাকবে সে। মেয়ের বাবা পরপারে গিয়ে বেঁচে গেছে। এসব চিন্তায় সে দারুণভাবে অস্থির। বিধবা মায়ের আহাজারিতে চারদিকের পরিবেশ ভারি হয়ে গেল। আশেপাশে সবাই পুশিকে অনেক করে বোঝানো সত্ত্বেও তার কান্না যেন থামে না। মেয়ের মায়ের শতক্রন্দন পাশ কাটিয়ে সামাজিক নিয়মানুযায়ী নববধূকে কলাগাছের খোলের তৈরি পালকিতে চড়িয়ে তুশি চলে গেল তার নিজের বাড়িতে।

বউভাতের দিন। আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে খেয়ে দেয়ে তুশিকে দারুণ প্রশংসা করলো। সম্পর্কের দাদি-নানিরা এসে বর ও কনের আশীর্বাদ করে তাদের মুখে শতবার চুমু খেতে লাগলো। চারদিকে তখন বেশ আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছিল। হেঁশেল থেকে মা জাহিদা বেগম তার দুই মেয়েকে ডেকে ডেকে অস্থির। কিন্তু কেউই আর তার ডাকে কোনো সাড়া দিচ্ছে না তখন। এখন তাদের খাওয়া-দাওয়ার দিকে তেমন কোনো খেয়ালই নেই।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর শুধু পুশির কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেল। সে তখন চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে তুললো। সে মুহূর্তে তার চিৎকারে রান্নার কাজ ফেলে দৌড়ে তার কাছে এলেন জাহিদা।
-    এখনে তোমার কী হয়েছে মামণি। এমন করে কাঁদছো কেন। খেলা করতে গিয়ে এমন করে কাঁদতে নেই মা। তুমি শান্ত হও।
-    আমি কেন কাঁদবো না মা? তুশি আমার মেয়েকে আমার বাড়িতে আসতে দিচ্ছে না। আমার মেয়ে আমার বাড়িতে আসবে না,এ আবার কেমন কথা?
-    কেন সে মেয়েকে আসতে দেবে না? এটা তো ভীষণ অন্যায় মা। চলো এখন খাবে ,ঘরে এসো।
-    না আমি কিছুতেই খাব না। আগে তুশি আমার মেয়েকে ফেরত দিক। তা না হলে আমি কাঁদবোই।
-    সে সব পরে হবে মা। এখন তুমি ঘরে চলোনা  মা মনি।
-    না,আমি আমার মেয়েকে ছাড়া কিছুতেই ঘরে যাব না। আমার বিয়ে হলে তখন তুমি কী তোমার মেয়েকে বাড়িতে আনবে না। আর বরপক্ষ তোমার মেয়েকে না আসতে দিলে তুমিও কী আমার মতো কাঁদতে না? বল মা,বলো?

নিজের মেয়ের মুখে এমন কথায় চমকে উঠেন মা। এতটুকু ছেলে মেয়েরা বিয়ের সব চালচলন এখন থেকেই ভালোভাবে বুঝতে শিখেছে। পুশির পুনরায় কান্না দেখে দারুণ বিপদে পড়েন জাহিদা। শেষে তুশির কাছে পুশির মেয়েকে ফেরত দিতে বিশেষ অনুরোধ জানান তিনি। কিন্তু তুশি কিছুতেই সে প্রস্তাবে রাজি হয় না।

তার কথা,‘আমার ছেলের বউ কখন বাপের বাড়িতে যাবে না যাবে তা আমিই ঠিক করবো। ’ বিয়ের পরে মেয়ের মা বাবার সাধারণত মেয়ের উপর তেমন কোনো অধিকার থাকে না। আর এটাই সামাজিক নিয়ম। তুশিকে আবার বুঝিয়ে হেঁশেলে যান তিনি।


মেয়েকে ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো সমাধান না হওয়ায় খাবার না খেয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকে পুশি। ঠিক দুপুরে ইকবাল সাহেব খাবার খেতে বাড়িতে আসেন। তিনি পুশিকে শুয়ে থাকতে দেখে জাহিদার কাছে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চান।  
-    পুশি অমন করে বিছানায় পড়ে আছে কেন জাহিদা? কী হয়েছে ওর?
-    পুশির মেয়েকে তুশির ছেলের সাথে আজ  সকালে ঘটা করে বিয়ে হয়েছে। এখন তুশি তার পুত্রবধূকে পুশির বাড়িতে আসতে দিচ্ছে না। কারণ পুশি তার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে ঘড়ি, সাইকেল আর রেডিও দিতে পারে নি।
-    ও এই কথা। ঠিক আছে যাও,আমি যৌতুকের সব ব্যবস্থা করে দেব। পুশির মেয়েকে তুশি  নতুন জামাইসহ পুশির বাড়িতে ফেরত দেবে।
পরিশেষে সবার অনুরোধে তুশি তার ছেলের বউকে তার বাপের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিল। তারপর পুশি বিছানা হতে নেমে এসে তুশির কাছ থেকে মেয়েকে নিয়ে শত আদরে বার বার চুমু খেতে লাগলো। আর এভাবেই আনন্দ ফিরে এলো তাদের ছোট সংসারে।

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।