ঢাকা: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে কোণঠাসায় থাকা জামায়াতে ইসলামী ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে সরকার পতনের পর রাষ্ট্র ও সরকারের ডাকে সাড়া দেওয়া, হিন্দু ধর্মের মন্দির পাহারা দেওয়া, আন্দোলনে হতাহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া এবং বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা অন্যতম।
এমন পরিস্থিতে এই দলটি এখন তিনটি এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে। এ তিনটি এজেন্ডা হচ্ছে, ১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিষিদ্ধ করে গেজেট তা প্রত্যাহার করা, সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে নিবন্ধন ফিরে পাওয়া। এই দুটি কাজ শেষ হওয়ার পরে প্রতীক কি হবে কি হবে না সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।
শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এরপর ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তবে আপিলে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডভোগরত অবস্থায় গত বছর জামায়াতের আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমও মৃত্যুবরণ করেন।
নিবন্ধন অবৈধ
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ রিট করেন। রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আরজি জানান।
এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হয়। একই বছরের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
গত বছরের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এদিন আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানীয়া আমীর ও আহসানুল করীম। জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জিয়াউর রহমান।
পরে জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধা রয়েছে। আর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনও অনুপস্থিত। এই ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে ছয় সপ্তাহ সময় চেয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের আইনজীবীরা উপস্থিত নাই সেহেতু আদালত এটা ডিসমিস ফর ডিফল্ট করেছেন। অর্থাৎ আইনজীবী উপস্থিত না থাকার কারণে খারিজ করেছেন।
পরবর্তীতে আইনি সুযোগ কি আছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রেস্টোর আবেদনের সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে এটা আদালতের এখতিয়ার।
দাঁড়িপাল্লা প্রতীক
২০১৬ সালে ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে যেন বরাদ্দ না দেওয়া হয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। তার আগে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট (সব বিচারপতির অংশগ্রহণের সভা) সভায় দাঁড়িপাল্লার বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত হয়।
পরে ২০১৭ সালের মার্চে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাদ দেয় নির্বাচন কমিশন।
নিষিদ্ধ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়।
পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেটের মাধ্যমে ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকার।
জামায়াত–শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। আপিল বিভাগ ওই রায়কে বহাল রেখেছেন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল বলে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য–প্রমাণ রয়েছে। সরকার বিশ্বাস করে যে জামায়াতে ইসলামী, শিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
তাই জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। গঠন করা নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তৎপর হয়। সোমবার এ বিষয়টি জানাতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
তিনি বলেন, জামায়াতের সামনে এখন ইস্যু হলো সরকারিভাবে নিষিদ্ধের আদেশ প্রত্যাহার করা। জামায়াতের দ্বিতীয় এজেন্ডা হলো এই রেজিস্ট্রেশন মামলাটি উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি করা। এই দুই কাজ করার পর পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এর প্রতীক কী হবে কী হবে না। যেহেতু রেজিস্ট্রেশন মামলার আগে তার প্রতীক যেভাবে ছিলো, আপিল বিভাগ যদি পজিটিভভাবে এ মামলা নিষ্পত্তি করেন তাহলে অতীতের প্রতীকই তারা ফিরে পাবে। এটিই আইনগত বিধান।
প্রতীকের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, রায়ের মাধ্যমে নয়-এমন প্রশ্নে শিশির মনির বলেন,ফুলকোর্ট একটি প্রশাসনিক বডি। বিচারিক কার্যকরণের ক্ষমতা তাদের নেই। হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগের বিচারিক কার্যকরণের ক্ষমতা আছে। কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই কোনো বিচারিক সিদ্ধান্তের ওপরে প্রাধান্য পাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা,আগস্ট ২৬,২০২৪
ইএস/এমএম