ঢাকা: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে জারি করা রুলের ওপর পঞ্চম দিনের মতো শুনানি শেষ হয়েছে।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে বুধবার (১৩ নভেম্বর) শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে রুলকে সাপোর্ট করি। তবে পুরো পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চাই না। কয়েকটা জায়গা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধংস করা, ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত করা, সংবিধানের সুপ্রিমেসি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এটা সংবিধানের ওপর প্রতারণার শামিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাতিলটা গণতন্ত্রের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। রায়ের জন্যও অপেক্ষা করেনি। এটা সংবিধানের, মানুষের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এটা বলেছি। ১২৩ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য বহাল রেখে আবার নির্বাচন করা অবৈধ। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করে।
সংবিধানে ‘জাতির পিতার’ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার’ প্রশ্নে বলেছি, এখানেও আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ওনার অবদান অনস্বীকারর্য। রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে উনি অনেক ওপরের মানুষ। কিন্তু একজন ব্যক্তি সব কিছু করেছেন–এটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার ধারণা নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উই দ্য পিপল অব বাংলাদেশ। আমরা সবাই স্বাধীন হয়েছি। এই কথা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে। ‘উইনেস’ থেকে সরে এসে আমরা ‘আইনেস’ এবং বায়োপিক থিউরিতে গেছি। এটা আমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে যে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত না। আমাদের দেশ রাষ্ট্র সমাজকে ধংস করে দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা একক শব্দ ইস্যু নয়, ইস্যু হলো ওনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার জন্য এবং যেভাবে করেছেন; মুক্তিযুদ্ধে তার কৃতিত্বটাকেও ধংস করার জন্য ওনারা দায়ী।
সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ এবং সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত অনুচ্ছে ৭ ক ও খ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, গণতন্ত্রকে হত্যা, সংকুচিত ও নির্বাসিত করার জন্য এই ৭ ক ও খ করা হয়েছে। মানুষকে ভয়ের সংস্কৃতি ও কণ্ঠরুদ্ধ করা।
গণভোট নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণের সাংবিধানিকভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কথা বলার গণভোটের বিধান বিলোপ করে কণ্ঠরোধ করেছে।
২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়।
পরে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে সুজন সম্পাদক বদিউল আলমসহ ৫ ব্যক্তি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) তিনটি আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আগামী ১৭ নভেম্বরের ওপর শুনানির তারিখ রয়েছে। অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি চলছে হাইকোর্টে।
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। পরে এই রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসেবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২৪
ইএস/এমজেএফ